নারীর প্রতি বৈষম্য কমেনি, বেড়েছে সহিংসতার ভয়াবহতা

ফাইল ছবি

দেশে নারীশিক্ষার হার ও কাজে অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীর নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। বরং নারীর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহতা বেড়েছে।

‘৫০ বছরে বাংলাদেশ: ফিরে দেখা ও ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট ও মিত্তাল ফাউন্ডেশনের আয়াজনে অনলাইনে দুই দিনের সম্মেলনের দ্বিতীয় ও শেষ দিন বৃহস্পতিবার আলোচকদের কথায় এমনটাই উঠে আসে।

জেন্ডার এক্সপার্ট ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের প্রভাষক মার্টি চেন-এর সঞ্চালনায় ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ নিয়ে অধিবেশনে মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে এ আলোচনায় হয়তো স্বাভাবিকভাবে কিছু ইতিবাচক কথাবার্তা প্রত্যাশিত। কিন্তু নারীদের জীবনে গত ৫০ বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে, হয়তো অনেকটাই এগিয়েছে, কিন্তু ইতিবাচক উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে কিছু নেতিবাচক ফলাফলও আছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারীরা সামনে এগিয়ে এসেছে, কিন্তু তারা কি মুক্তি ও ন্যায়বিচার পাচ্ছে?

হামিদা হোসেন ছাড়াও নারী আন্দোলন কর্মী ও নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা শিরিন হক, বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক নায়লা কবীর মতামত তুলে ধরেন।

নারীর প্রতি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য চলছেই
হামিদা হোসেন বলেন, নারী তাঁর ধর্ম, এলাকা, সম্প্রদায়ভেদে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, এই বৈষম্যের প্রধান কারণই লিঙ্গ। বৈষম্য এবং সহিংসতাকে প্রতিহত করতে নারীদের কৌশলী হতে হয়েছে তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে।

তিনি বলেন এ অঞ্চলে, নারীর অধিকার আদায়ের লড়াই স্বাধীনতার আগে থেকেই। তারপরও এখনো বৈষম্যের মধ্যে আছেন নারীরা।

হামিদা হোসেন বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নতির আলোচনায় নারীরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলেও নারীশ্রমিকেরা সমান পারিশ্রমিক, নিরাপদ কর্মপরিবেশ দাবি করেও পাচ্ছেন না। শ্রমিকদের নিম্ন মজুরি আর কারখানা দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা এখনো ঘটে চলেছে।

বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করির সমন্বয়কারী ও নারী অধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, একটা সময় অনেকের প্রশ্ন ছিল, এখানে নারীদের কেন বাইরে দেখা যায় না? এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। শহরে গণপরিবহন থেকে শুরু করে সব জায়গায় নারীর অবস্থান দৃশ্যমান।

তিনি বলেন, গ্রামে নারীদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। তাঁরা মাঠে কাজ করছেন ঠিকই কিন্তু পুরুষদের তুলনায় মজুরি পাচ্ছেন কম। পুরুষ তাঁর কাজের জন্য যেখানে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা পাচ্ছেন, সেখানে নারী পাচ্ছেন ৩০০ থেকে ৩৫০।
নারী খাদ্য উৎপাদন করছেন, সেটাকে বাজারে পৌঁছে দিচ্ছেন, কিন্তু অর্থনীতিতে তাঁরা যে শ্রম দিচ্ছেন সেটার মূল্যায়ন হচ্ছে না।

নারীপক্ষের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিরিন হক মনে করেন, নারী ও মেয়েশিশু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির মধ্যে বা তার আগে এমনটা আরও দেখা গেছে। তিনি বলেন, আইন কিংবা সামাজিক জীবন দুই জায়গাতেই বৈষম্য বিরাজ করছে। গত পাঁচ দেশে অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে, নারীদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বেড়েছে, যা বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে একধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

অল্পবয়সী মেয়েরা বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তারা সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়। তবে ভবিষ্যতে লিঙ্গভিত্তিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই বাড়বে, মত শিরিন হকের।
নারীর নিরাপত্তায় এখনো পিছিয়ে

নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হয়ে উঠে আসে আলোচনায়।
নারীর সামনে এখনো অনেক বাধা ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক নায়লা কবির। তিনি বলেন, পাবলিক ডোমেইনে নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন নানাভাবে। বাংলাদেশে বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে এ ধরনের হয়রানির ক্ষেত্রে সরকারের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

খুশী কবির মনে করেন, নারীরা বাইরে বেরিয়ে এসেছেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের নিরাপত্তা কমে গেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। তিনি বলেন, আগে নিরাপত্তাহীনতা ছিল না, তা নয়। কিন্তু বর্তমানে সহিংসতার নির্মমতা, ভয়াবহতা বেড়েছে। এর মানে হচ্ছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই সবকিছু নয়। এ ছাড়া কেউ কেউ ধর্মকে অপব্যবহার করছে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।

হামিদা হোসেন নারীর ওপর প্রকাশ্যে ফতোয়া প্রদান ও শাস্তির কথা তুলে ধরে বলেন, ১৯৯৩ সালে প্রথম সংবাদপত্রের পাতায় খবর আসে সিলেটে নুরজাহান নামে এক নারীকে ফতোয়া দিয়ে নির্যাতনের পর সে আত্মহত্যা করেছে। এ ঘটনায় নারী আন্দোলনকর্মীরা মামলা করেন। ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট ফতোয়াকে বেআইনি ঘোষণা করে রায় দেয়। কিন্তু মাঝখানে পেরিয়ে যায় ২০ বছর। তবে তিনি মনে করেন, এই রায় গ্রামের মোড়ল বা ইমামদের দ্বারা নারীদের ওপর এমন নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশকে অভিযোগ জানানোর পথ খুলে দেয়।

তিনি আরেকটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বলেন নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের যৌন হামলার পর অভিযুক্তরা পার পেয়ে যায়। পরে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করা হলে উচ্চ আদালত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল।

নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
নারীপক্ষের শিরিন হক বলেন, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে হাজার হাজার নারী স্থানীয় কাউন্সিলগুলোতে বসছেন। এর ফলে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সামাজিকভাবে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
প্রশ্নোত্তর পর্বে খুশী কবির বলেন, নারীরা বাইরে কাজ করছে, কিন্তু যারা পথ তৈরির কাজটা করছে তাদের ভয়াবহ সহিংসতার শিকার করতে হয়। গ্রামীণ এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতায় তিনি জানান, সমর্থন পেলে নারীরা পাল্টা শক্তি নিয়ে কাজে এগিয়ে যায়, কিন্তু কতক্ষণ তাদের সঙ্গে সেই সমর্থন থাকবে, সে বিষয়ে তারা সন্দেহমুক্ত হতে পারে না। অনেক সময় পাড়া–মহল্লায় শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে হাতিয়ার হয়ে ওঠে নারীদের ধর্ষণ।

কোভিড পরিস্থিতিতে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সঞ্চালক মার্টি চেন। বাল্যবিবাহ বেড়েছে উল্লেখ করে আলোচকেরা বলেন, সরকার মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে একধরনের চতুরতার পরিচয় দিয়েছে আর এর অপব্যবহার করছে অভিভাবকেরা।

খুশী কবির বলেন, ’৭০–এর দশকে দেখেছি আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। পরিস্থিতি এখন কতটা বদলেছে, সে প্রশ্ন উঠে আসে তাঁর কথায়।
তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে আমাদের নাগরিকত্ব আছে? আমরা চাইলে কি অনেক কিছু বলতে পারি?’

বর্তমান সময়ে এসে নারীদের ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে কাজে যুক্ত হচ্ছে, একই সঙ্গে তাঁদের ইন্টারনেটের জগতেও জায়গা করে নিতে হচ্ছে। সে জায়গায় তাঁদের জন্য বৈষম্যহীন পরিবেশ তৈরি এবং নিরাপত্তার জন্য সরকার ও নারী সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্কের বিস্তৃত ভূমিকা নেওয়া জরুরি বলে আলোচনায় উঠে আসে।