ভাস্কর নভেরা আহমেদ ভাস্বর হয়ে আছেন কবি সাইয়িদ আতীকুল্লাহর কবিতার এমন অক্ষরমালায়:
‘নভেরাকে কি মনে পড়ে না?
কি অভিমানিনী সে আসে না কোনো দিন শহীদ মিনারে—
শহীদ মিনার কী করুণ ডাকে সেই নভেরাকে
কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বারবার
যিনি একুশের দিনে নভেরাকে
আত্মার ভেতর থেকে তুলে এনেছিলেন।’
বাংলা ভাষা আন্দোলনের রক্ত মহান স্মৃতির স্মারক ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম ভাস্কর নভেরা আহমেদকে ঘিরে যেন কিংবদন্তি ও কুহকের শেষ নেই। কিন্তু এক জীবনে তাঁর কর্মের বৈচিত্র্য প্রভা এবং অসীমের আকুলতা সে অনুপাতে আলোচিত হয়েছে কম। শিকোয়া নাজনীন ‘নভেরা: শিল্পের রহস্যমানবী’ (প্রথমা প্রকাশন, মার্চ ২০২১) বইয়ে জীবনকথার সমান্তরালে তাঁর শিল্পকর্মের তত্ত্বীয় বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে নভেরাকে ঘিরে ঘনীভূত রহস্য উন্মোচনে প্রয়াসী হয়েছেন।
গত শতকের চল্লিশের দশকে জন্ম নেওয়া বাঙালি মেয়েটির চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও কলকাতায় অতিবাহিত শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য, পঞ্চাশের শুরুতে লন্ডন গমন ও ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসের মডেলিং ও স্কাল্পচার বিভাগে ভর্তি হওয়া, দেশে ফিরে ১৯৫৭ সালে হামিদুর রহমানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ, ১৯৫৮ সালে ঢাকায় প্রথম ‘মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য’ তৈরি এবং হামিদুর রহমানের সঙ্গে যৌথ প্রদর্শনী, ১৯৬০ সালে ঢাকায় প্রথম একক প্রদর্শনী, ১৯৬১ সালে লাহোরে জাতীয় চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও ছাপচিত্র প্রদর্শনীতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত হওয়া, শাস্ত্রীয় নৃত্যে তালিম লাভ, ১৯৭০ সালে ব্যাংককে যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে নির্মিত মনুমেন্টাল ভাস্কর্য প্রদর্শনী, ১৯৭৩ সালে প্যারিসে একক ভাস্কর্য ও চিত্র প্রদর্শনী, ১৯৯৮ সালে চার দশক পরে তাঁর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে ভাস্কর্য প্রদর্শনী, ২০১৪ সালে ৪৫ বছরের ভাস্কর্য-ফসল নিয়ে প্যারিসে ‘রেট্রোসপেকটিভ’, জীবনজুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশ পরিভ্রমণ এবং ২০১৫ সালের আজকের দিনে প্রয়াণের রেখায় শিকোয়া নাজনীন নভেরাকে নতুনভাবে তুলে ধরেছেন। তথ্যের বিন্দু ধরে তিনি পৌঁছাতে চেয়েছেন নভেরা-জীবনের সারসত্যে।
নভেরার বিহঙ্গী-সত্তার উন্মেষকে পাখপাখালির এমন পটভূমিতে প্রতিস্থাপন করেন লেখক:
‘নভেরা তাঁর দেশের পৈতৃক বাড়ির ঠিকানা লিখতেন—৭৬, কিউ মিল্লাত রোড, কোতোয়ালি, চিটাগাং। পাহাড় আর বিস্তৃত অরণ্যঘেরা আসকারদীঘির পাড়। গভীর কালো জল। তৃষ্ণা নিবারণ ছাড়াও এই দিঘি ঘিরে গড়ে ওঠে নানা মিথ। এখানেই ছিল রামকৃষ্ণ মিশন। শত সন্ন্যাসী পাহাড়ি অঞ্চলে আসেন জপ করতে। একটা ছোট টিলাতে গভীর অরণ্য, সেখানে শজারু, মায়াহরিণ, শঙ্খচূড়—কী নেই। পাখির তো হিসাব নেই কোনো। বিচিত্র পাখি আসে। বসন্তবাউরি, ধনেশ। এক জাতের পাখি কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ।’
পাখির উড়ে চলা স্বভাবের সঙ্গে ভীষণ মিল ছিল নভেরার। কোনো ধরাবাঁধা গন্তব্য বা প্রথাগত বসে থাকা নেই; অনন্তের অন্বেষায় দিক্-দিগন্তের পানে উড়ে যাওয়া কেবল। রক্ষণশীল, পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিহঙ্গ-ভাষা রচনা করে গেছেন তাঁর ভাস্কর্য-সমুদয়ে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নভেরা নগর ঢাকায় এক নতুন পাখির সুর হয়ে বাজেন:
‘এই শহর তাঁকে যেমন করে দেখতে পারলে খুশি হতো, সেসব কোনোটাই নভেরার চরিত্রে ছিল না। ২৮-২৯ বছর বয়সী এক তরুণ নারী শিল্পী উৎসাহী জনতার সামনে ছেনি, হাতুড়ি, বাটালি নিয়ে স্টুডিওতে বা কখনো মিস্ত্রিদের সঙ্গে কাজ করছেন, অভূতপূর্ব সব শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন, শহীদ মিনারের পাশে তাঁবু খাঁটিয়ে রাত-দিন নিমগ্ন খেটে একটি জাতির ইতিহাসের স্মারক তৈরি করছেন—এই দৃশ্য কারও স্বাভাবিক লাগেনি।’
নভেরা পোষমানা পাখি ছিলেন না। বুনো পাখির স্বাধীনতার উল্লাসে গড়েছেন তাঁর স্বতন্ত্র ভাস্কর্য-ভুবন। পশ্চিমের প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা তাঁকে ঔপনিবেশিক অনুকৃতির পথে ধাবিত করেনি বরং কৃষিবাংলার পলি-পটভূমি এবং একই সঙ্গে যুদ্ধসংকুল পৃথিবীর ঝোড়ো আবহাওয়া তাঁর ভাস্কর্যের প্রধান প্রাণ। বিচ্ছিন্নতার কালে তাই ‘পরিবার’ হয়ে ওঠে তাঁর কাজের কেন্দ্রধ্রুবা, হিংসার সমকালে বুদ্ধের নির্বাণ দর্শন তুলে তুমুল আলোড়ন। ‘চাইল্ড ফিলোসফার’ থেকে ‘কাউ অ্যান্ড ফ্যামিলি’-এর মতো ভাস্কর্যে বঙ্গীয় লোকরীতির টিপছাপ যেমন খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি ভাস্কর্যের অনাড়ম্বর, রুক্ষ, ধূসরবর্ণা স্বভাব প্রমাণ করে, নভেরা বৈরী বাস্তবকে দিতে চেয়েছেন বিশ্বস্ত ভাষা। ভাস্কর্য বা শিল্প তাঁর কাছে উপরিতলার প্রসাধন ছিল না, ছিল জীবনের অবিকল্প উপাদান। শিকোয়া নাজনীন সংগতই বলেছেন, ‘তাঁর স্বপ্ন ছিল নগরীকে ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো। তিনি বলেছেন, আমাদের উচিত প্রাত্যহিক জীবনে শিল্পের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে রাখা এবং জীবনের অন্তর্নিহিত দৃষ্টি জাগিয়ে রাখা।’
নভেরাকে লেখক বলেছেন ‘শিল্পের রহস্যমানবী’। সত্যিই রহস্যের ঘেরাটোপে আবদ্ধ শিল্পীর জীবন আবার তাঁর শিল্প-মূল্যায়নেও বহমান রহস্যময় নীরবতার ধারা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম নির্মাতা হিসেবে তিনি তাঁর যথাযথ স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, সুদীর্ঘকাল সুদূর প্রবাসজীবন কাটিয়েছেন, এ দেশের কয়েক প্রজন্ম ব্যক্তি নভেরা ও তাঁর ভাস্কর্যের ধারাবাহিক সান্নিধ্য-সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তবে নভেরাকে নিয়ে আমাদের অপার আগ্রহ ও ভালোবাসাও অশেষ। বেঁচে থাকতেই তাঁকে নিয়ে উপন্যাস লেখা হয়েছে (‘নভেরা’, হাসনাত আবদুল হাই), বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর তাঁর অনুপস্থিতিতেই ১৯৯৮ সালে আয়োজন করেছে তাঁর বড় আকারের ভাস্কর্য প্রদর্শনী, জীবদ্দশাতেই তাঁর স্মরণে জাদুঘরে স্থাপিত হয়েছিল একটি হল (অধুনালুপ্ত), প্রয়াণের পর বাংলা একাডেমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ভাস্কর নভেরা প্রদর্শনী কক্ষ’, তাঁর স্মরণে প্রকাশিত হয়ে চলেছে একাধিক গবেষণাকর্ম ও স্মারকগ্রন্থ।
নভেরা আহমেদ কোনো আত্মজীবনী লিখে যাননি, তবে শিকোয়া নাজনীন মনে করেন, তাঁর এক একটি আলোকচিত্রই ধারণ করে আছে তাঁর জীবনগল্প। স্বদেশ থেকে বিদেশ বিভুঁইয়ে থেকেও যিনি ভোলেননি বাঙালি নারীর প্রিয় পরিধেয় শাড়ি; সেই শাড়ির নন্দনে তিনি খুঁজে পান নভেরার স্বদেশি নন্দন। বিদেশি নদীর ধারে বসত করা তাঁর আত্মার ভেতরে বহতা দেখেন শঙ্খ কিংবা বুড়িগঙ্গা। প্যারিস কিংবা ভেনিসে ঘুরে বেড়ানো প্রাজ্ঞ ভাস্করের ভেতর লেখক দেখেন তারুণ্য-যৌবনে লক্ষ্মীবাজার-শাঁখারীবাজার-আশেক লেনের নারী বিরল রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো স্বাধীনচেতা নভেরাকে।
অতঃপর বেলাশেষের ঘণ্টা পড়ে। শিকোয়া নাজনীন গবেষকের অধিক শিল্পীর অক্ষর তুলিতে এঁকেছেন সেই পড়ন্ত প্রহরের বিষাদিত রূপ:
‘ফরাসি দেশে তাঁর ঘরের একটা ছবি আছে। ছবিতে একটি খোলা জানালা দিয়ে নভেরার শূন্য ঘর দেখি আমরা। কিছু গাছগাছালি, বুনো পত্রালি বরাবর একটা খালি চেয়ার পড়ে থাকে সেখানে। আমরা দেখতে পাই নভেরার শব নিয়ে যাওয়ার গাড়ি, অনেকক্ষণ থেমে থাকার পর ধীরে ধীরে চলে যেটি। রোদ না, জল না, হাওয়া না, শুধু এক কফিন টানা গাড়ি দেখি আমরা। যেন এইমাত্র একটি গল্পের মৃত্যু হলো। শেষ হলো আমাদের বাংলার ষাটের দশকের জনপদের এই উজ্জ্বল আখ্যান। একটি চকচকে মেহগনি কাঠের কফিন, আর মধ্যে অ্যান্টিক কারুকাজ, ডালা বন্ধ। ভেতরে নভেরা।’
নভেরার মৃত্যুর দিনেই মৃত্যু হয় তাঁর প্রিয় সঙ্গী পাখিটিরও। একই সঙ্গে অনন্তযাত্রায় চলে বাস্তবের ফরাসি-পাখি আর ‘নভেরা’ নামের বাংলার শিল্পপাখি। পাখি হওয়ার ব্যাকুল বাসনা ছিল যে নভেরার; চলে গিয়েও তিনি তো ফিরে ফিরে আসেন বাংলার মাঠঘাটে, তাঁর সৃজিত শহীদ মিনারের নম্র বেদিমূলে, আমরি বাংলা ভাষার মধুর স্বরে আর সুরে।
পিয়াস মজিদ: কবি ও প্রাবন্ধিক