নদীর ধারাবাহিক ভাঙনে ছেদ টানবে কে
সিইজিআইএসের পূর্বাভাসে এ বছর ভাঙনপ্রবণ যে ১৩টি অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে, বর্ষার শুরুতেই নদী ভাঙছে তার মধ্যে ৮ জেলায়। পাউবোর দাবি, নদী কখন, কোথায় ভাঙবে, তা আগে থেকে বলা মুশকিল।
এবারও যমুনার ভাব ভালো লাগছে না মোহাম্মদ আলীর। এক জীবনে এই নদী ১৩ বার তাঁর বসতঘর নিয়েছে। যমুনার পাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখছিলেন, সেই নদীর ঢেউ কীভাবে বড় হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ সদরের পাঁচঠাকুরী গ্রামে নদীর পাড়েই কথা হলো বৃদ্ধ মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। প্রথম আলোর কাছে তাঁর একটা সরল জিজ্ঞাসাও ছিল, শুধু বর্ষাকালে নদীতে বালুর বস্তা ফেলা হয় কেন?
মোহাম্মদ আলীর এ প্রশ্ন তাঁর একার নয়, সারা দেশের ভাঙনকবলিত সব মানুষের প্রশ্ন। এই প্রশ্ন নিয়ে আমরা গিয়েছি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। আমরা গিয়েছি সরকারের ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) কাছে। আমরা গিয়েছি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, নদীভাঙন রোধে তাদের সারা বছরের কাজের ৭০ ভাগই জরুরি ভিত্তিতে করা হয়। মানে ভাঙন শুরু হলে ঠেকানোর চেষ্টা চলে।
মোহাম্মদ আলীর প্রশ্ন ছিল আগেভাগে, শুকনা মৌসুমে কি নদীর ভাঙন রোধে কাজ করা যায় না? পাউবোর দাবি, নদী কখন, কোথায় ভাঙবে, তা আগে থেকে বলা মুশকিল। তারপরও পাউবোর কর্মকর্তারা অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করতে পারেন, স্থানীয় পর্যায়ে কোথায় কোথায় ভাঙতে পারে নদী।
কিন্তু সরকারের ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস তো ১৭ বছর ধরে বড় তিনটি নদীর ভাঙনের পূর্বাভাস দিয়ে আসছে। মানে, কোন এলাকায় কখন কোন নদী ভাঙবে, তা আগেভাগেই জানাচ্ছে বলে দাবি করছে তারা। সেই পূর্বাভাস কয়েক বছর ধরে ফলাও করে পত্রিকায়ও প্রকাশ করা হচ্ছে। তা কি সরকারের অপর সংস্থা পাউবো জানতে পারে না? তা কাজে লাগিয়ে আগাম পরিকল্পনা কি করা সম্ভব? এই প্রশ্ন নিয়ে আমরা সামনে হেঁটেছি।
সিইজিআইএস ভাঙন পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে ২০০৪ সাল থেকে। ২০২০ সালে স্যাটেলাইট চিত্র থেকে তৈরি ভাঙন পূর্বাভাসের সঙ্গে বাস্তবে মিলেছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। পাউবোও মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে ভাঙনের আগাম ধারণা নিয়ে থাকে। তাহলে পরিস্থিত বদলাচ্ছে না কেন? দুর্বলতা কোথায়? স্থানীয় পাউবোর কোনো কোনো কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, সিইজিআইএসের পূর্বাভাস তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে পান না। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তা পূর্বাভাস পান বলেও জানান। তবে নিজেদের সনাতন কর্মকৌশলকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তাঁরা। পূর্বাভাসকে আমলে নিতে আগ্রহী নন এই কর্মকর্তারা।
আপাতসরল দৃশ্য
সিইজিআইএসের পূর্বাভাসে এ বছর ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা বগুড়া, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ীসহ ১২ জেলার পাউবো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। একজন কর্মকর্তা তো খুব দম্ভের সঙ্গে বললেন, ‘আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আমরা দেখছি।’ তাহলে এত মানুষ প্রতি বর্ষায় গৃহহীন হয় কেন? কেন টিনের চালে উঠে বসে থাকে মানুষ আর পোষা প্রাণী? কেন বাবার কবর তলিয়ে যায়। কেন সন্তানেরা ছোটে শেষবারের মতো জিয়ারত করতে? পত্রিকায় দৃশ্যমান হয়, হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে পদ্মায় ডুবে যাওয়ার আগমুহূর্তে কবর জিয়ারত করছেন সন্তানেরা।
এ দৃশ্য সবাইকে হয়তো ছোঁয়ও না। কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও মাদারীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের জবাব প্রায় একই-জরুরি কাজ ভাঙন শুরু হলেই করা হয়। আগে থেকে ধারণা করার সুযোগ নেই, কোথায় পাড় বিলীন হবে।
পূর্বাভাস ও এবারের ভাঙন
সিইজিআইএসের পূর্বাভাসে এ বছর ভাঙনপ্রবণ যে ১৩টি অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে, বর্ষার শুরুতেই নদী ভাঙছে তার মধ্যে ৮ জেলায়। কুড়িগ্রামে ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর ২৫ জায়গায় এখন ভাঙন চলছে। জেলার বিদ্যানন্দ, বজড়া, বেগমগঞ্জ, কালীগঞ্জসহ ১৭টি জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন রোধে কাজ করছে পাউবো। কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভাঙন রোধে ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
গাইবান্ধার ৩৩টি পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে। তিস্তায় ডুবছে জেলার সুন্দরগঞ্জের হরিপুর, কাপাসিয়া। ব্রহ্মপুত্রের স্রোতে বিলীন হচ্ছে সদরের কামারজানির কয়েক জায়গা। যমুনার পানি টেনে নিচ্ছে ফুলছড়ি আর সাঘাটার ৫ ইউনিয়নের বসতি। শুধু ফুলছড়ির উড়িয়ায় ফেলা হচ্ছে জিও ব্যাগ।
টাঙ্গাইলে সদর, গোপালপুর, ভূঞাপুর, কালিহাতী ও নাগরপুরে শুরু হয়েছে ভাঙন। যমুনার প্রবল স্রোতের মুখে টাঙ্গাইলের ১ হাজার ২৬৩ হেক্টর জমি-বসত এবার ঝুঁকিতে। গত বছর সদরের কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলি ও কাকুয়া গ্রামে ব্যাপক ভাঙনের পর এবারও শুরু হয়েছে ভাঙন। এর মধ্যে চরপৌলি এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা চলছে। ভাঙন রোধে পাইকশা মাইঝাল গ্রামে কিছু জিও ব্যাগ ফেলা হলেও নিশ্চিন্তপুরে এখনো কাজ হয়নি। গ্রাম দুটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের পাঁচিল ইউনিয়নের বিরাট এলাকা গত বছর যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়েছে। হাট পাঁচিলের এক গ্রামের অর্ধেকটা বিলীন হয়েছে গত জুনের শুরুতে। জরুরি ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে পাঁচিলের সীমানায়।
দক্ষিণাঞ্চলের ফরিদপুর সদরের গোলডাঙ্গি, হাজীডাঙ্গী ও ভাঙ্গার মাথা এলাকায় চলছে ভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে একটি জায়গায় নেওয়া হয়েছে স্থায়ী ব্যবস্থা। বাকিটা প্রতিবারের মতো জরুরি জিও ব্যাগ। কমবেশি ভাঙন শুরু জামালপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়ায়ও।
ছেদ টানার সুযোগ কি আছে
সারা দেশের নদ-নদীর ভাঙন শুরু হয় জুন মাস থেকে। এবারও জুনের শুরুতেই নদীর পাড় ভাঙতে শুরু করে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইলসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েক জেলায়। কিন্তু সিইজিআইএস ভাঙনের পূর্বাভাসও দিয়েছে জুনের প্রথম সপ্তাহে। তাহলে পূর্বাভাস ধরে মাঠপর্যায়ে সমন্বয় করে আগাম পদক্ষেপের সময় কোথায়?
জানা গেল, পূর্বাভাস প্রকাশ করার আগে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে। সরকারি অফিসে অনুমোদন মানেই সময় ক্ষয়। ভাঙন শুরু হয়ে গেছে আগেই। পূর্বাভাস মেনে কত শতাংশ ভাঙন রোধ করা গেছে বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেই আলোচনা তোলার জন্য ১৭ বছর যথেষ্ট সময়।
সতর্কতার ঘোষণা কেন প্রয়োজন
প্রতিবার ভাঙনের পর সরেজমিন দেখা যায় হাহাকার। ঘর হারানোর, জমি-গরু হারানোর আক্ষেপ। কিন্তু কয়েক মাস আগে থেকে যে ভাঙনের ধারণা পাওয়া যেতে পারে, তা তাদের জানা নেই। এ তথ্য জেনে তারা বলল, তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে লাল পতাকা দিয়ে আগে থেকেই সতর্কতা জানিয়ে দেয়, তাহলে অনেক ক্ষতি তো কমিয়ে আনা সম্ভব। যে মানুষটি তিন মাস আগে থেকে জানবেন, তাঁর বসতভিটা বা ফসলের জমি নদীতে বিলীন হতে পারে, তিনি কিছু প্রস্তুতি নিতে পারেন। জমিতে নতুন ফসল লাগাবেন না তিনি। বাড়ির ভিটায় তুলবেন না আরেকটি ঘর। সরে যেত পারবেন সময়মতো। কমাতে পারবেন ক্ষয়ক্ষতি।
বাস্তবায়নের দায়িত্ব কার
মাঠপর্যায়ে নদীর অভিভাবক পানি উন্নয়ন বোর্ড। সিইজিআইএসের পূর্বাভাস নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। কেউ কেউ এই পূর্বাভাস পায়। প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক দপ্তর পায় না বলে দাবি করেছে। যারা পায় তাদের অনেকে একে দেখছে নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে। কেউ কেউ মনে করেন, তাঁদের নিজেদের এবং স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতাই বড় সহায়ক তাঁদের কর্মপ্রক্রিয়ায়।
তবে পাউবোর মহাপরিচালক এ কে এম ওয়াহেদ উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, সিইজিআইএসের পূর্বাভাসের সঙ্গে নিজেদের মাঠপর্যায়ে করা ধারণার মিল রেখে প্রস্তুতি নেওয়া হয়। তবে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে জরুরি মেরামত অর্থাৎ জিও বস্তা ফেলার কাজটি করার জন্য নির্বাহী প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেওয়া আছে।
সিইজিআইএসের পূর্বাভাস বলছে, এবার ভাঙনে বিলীন হতে পারে ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা। মানুষ, ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, অন্যান্য স্থাপনার তো আর্থিক মূল্য বিবেচনায় নিলে এর ক্ষতি ব্যাপক।
পূর্বাভাসের সীমাবদ্ধতা
এখন পর্যন্ত পূর্বাভাস পাওয়া যায় মাত্র তিন নদীর। আবার ভাঙনের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনের সব সূত্র এখনো তাদের করায়ত্ত নয়। সিইজিআইএসের রিভার, ডেলটা ও কোস্টাল বিভাগের সহযোগী বিশেষজ্ঞ সুদীপ্ত কুমার হোড় জানালেন, সাধারণত তিন রকম ধারণার ওপর ভিত্তি করে পূর্বাভাস তৈরি হয়। নদীর গতি পরিবর্তনশীল। তাই সব সময় একেবারে নিখুঁত ধারণা করাও সম্ভব নয়।’ তিনি বলেন, আরও বেশিসংখ্যক নদী নিয়ে কাজের আওতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। আগামী বছর থেকে আরও আগে পূর্বাভাস দেওয়ারও চেষ্টা করবে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এই পূর্বাভাস দেওয়ার কাজটি আরও ভালোভাবে সম্ভব যদি দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করা হয়।
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক প্রথম আলোকে জানান, দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করেই ভাঙনপ্রবণ এলাকায় কাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তিনি বলেন, দেশের সব কটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে স্থায়ী বাঁধ দিয়ে নিরাপদ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার তাৎক্ষণিক ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
শেষ কথা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. মুনসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নদীর সঙ্গে তাৎক্ষণিক যুদ্ধ করে ভাঙন রোধ করা যায় না। সে জন্যই পরিকল্পনার কথা আসে। নদী সারা বছর একইভাবে ভাঙে না। কোথাও পানি আসার সময়, কোথাও পানি নেমে যাওয়ার সময় ভাঙন হয়। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধের সময় সব প্রতিষ্ঠানকেই মনে রাখতে হবে, দেশ একটা। তাই পৃথক পৃথক অস্তিত্বের গুরুত্বের চেয়ে প্রয়োজন জনসাধারণের দুর্ভোগ কমানোর চেষ্টায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
নদীর এই ধারাবাহিক ভাঙনে ছেদ টানার উপায় কী? পুরো আলোচনা বলছে, সিইজিআইএসের পূর্বাভাস আগেভাগে যাতে দেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। গবেষণার পরিধি বাড়িয়ে আস্তে আস্তে সব নদীর ভাঙন নিয়ে আরও কার্যকর পূর্বাভাস তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে এই পূর্বাভাস আমলে নিয়ে সমন্বয় করে চলার বাধ্যবাধকতায় আনতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বর্তমানের ৭০ ভাগ জরুরি কাজকে স্থায়ী এবং ৩০ ভাগ স্থায়ী কাজকে জরুরি কাজে বদল করার পরিকল্পনা নিতে হবে মন্ত্রণালয়কে। তবেই কেবল সিরাজগঞ্জের পাঁচঠাকুরী গ্রামের মোহাম্মদ আলীর জীবনে ভাঙন থামানো সম্ভব হবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সফি খান, শাহাবুল শাহীন, খায়রুল ইসলাম, আবদুল আজিজ, আরিফুল গনি, কামনাশীষ শেখর, অজয় কুণ্ডু, এজাজ আহমেদ ও প্রবীর কান্তি বালা।]