নতুন মাদক আইনের মামলা ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে প্রচলিত আদালতে চলবে
হাইকোর্ট বলেছেন, রূঢ় বাস্তবতা হলো, ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪৪ ধারা অনুসারে কোনো ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা বা বিকল্প হিসেবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজদের ট্রাইব্যুনাল হিসেবে কাজ পরিচালনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আইনে কোনোরূপ সংশোধনও করা হয়নি। সৃষ্ট এ পরিস্থিতি অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও হতাশাজনক।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ রোববার এই অভিমতসহ রায় দেন। আদালত বলেছেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, বিচার কার্যক্রমে কোনো স্থবিরতা বা শূন্যতা থাকতে পারে না।’
রায়ে আদালত বলেছেন, ‘সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা এবং ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধির ৫ (২) ধারা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করেছি। সুচিন্তিত অভিমত এই যে যেহেতু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪৪, অর্থাৎ ট্রাইব্যুনাল গঠন কিংবা জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজকে ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার বিধানটি এখনো কার্যকর হয়নি, সেহেতু বিচারপ্রক্রিয়ায় শূন্যতা পূরণে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫ (২) ধারা এ ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য ও কার্যকারিতা পাবে।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বংশাল থানায় করা এক মামলায় মো. মাসুদুল হক মাসুদ নামের এক আসামির জামিন আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ওই রায় দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন রদ করে গত বছর ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮’ শিরোনামে নতুন আইন করে সরকার। এই আইনের ৪৪ ধারায় এ–সংক্রান্ত অপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।
আদালত বলেছেন, আইনের ৪৪ (১) ধারা অনুসারে ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা বা গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বিকল্প আদালতকে ক্ষমতা না দেওয়া অথবা আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুসারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ট্রাইব্যুনালসংক্রান্ত বিধান সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের আইনের অধীন দায়ের করা সব মামলার বিচারিক কার্যক্রম ফৌজদারি কার্যবিধির ৫ (২) ধারা অনুসারে কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলে উল্লেখিত ‘অন্যান্য আইনের অধীন অপরাধ’ বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
আদালতে জামিন আবেদনকারী মাসুদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আল ফয়সাল সিদ্দিকী। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি ধারামতে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা আছে, যা এখনো গঠন করা হয়নি। এ বিষয়ে আদালত উদ্বেগ প্রকাশ করলে বিষয়টি আইনমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, শিগগিরই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। হাইকোর্ট ট্রাইব্যুনাল না হওয়া পর্যন্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫ (২) ধারা অনুযায়ী অন্যান্য আইনের অধীনে অপরাধ বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হবে বলেছেন। ফলে, ট্রাইব্যুনাল না হওয়া পর্যন্ত আপাতত মাদক মামলাগুলো ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে প্রচলিত আদালতে বিচার হবে।
রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা বলেন, মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা পাঁচ বছরের অধিককাল সাজার বিধান যে আইনে থাকে, সে ক্ষেত্রে দায়রা আদালত বিচার করবেন, পরোয়ানা ইস্যু করতে পারবেন মহানগর হাকিম। এ ছাড়া দুই বছর কম সাজা ক্ষেত্রে বিচারিক হাকিমও বিচার করতে পারবেন।
বংশাল থানার ওই মামলায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি মাসুদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এরপর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ অভিযোগ আমলে নিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত-৩–এ পাঠান। এই মামলায় নিম্ন আদালতে জামিন চেয়ে বিফল হয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন মাসুদ, যেখানে ওই মামলা পরিচালনা আইনে সমর্থন করে না বলা হয়।
এই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৮ জুলাই হাইকোর্ট রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন। পাশাপাশি ট্রাইব্যুনাল গঠন–সম্পর্কিত পদক্ষেপের বিষয়ে অবহিত করতে স্বরাষ্ট্রসচিব ও আইন সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ঘোষিত রায়ে বলা হয়, এটা বাস্তবতা যে আইনটি গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হলেও ওই আইনের বিধান অনুসারে অর্থাৎ ৪৪ ধারা অনুযায়ী মাদকসংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব অদ্যাবধি প্রদান করা হয়নি।
রায়ে আদালত বলেছেন, ‘নিম্ন আদালতগুলোয় মাদকসংক্রান্ত মামলার জামিন ও বিচার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে এবং বিভিন্ন আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মামলার বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। বিভিন্ন ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত এই সৃষ্ট অচলাবস্থা লক্ষ করতে হচ্ছে। এই অচলাবস্থা দ্রুত নিরসনের জন্য গত মার্চে অ্যাটর্নি জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মৌখিকভাবে জানানো হয়। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত না হওয়ায় গত ৮ জুলাই এক আদেশে স্বরাষ্ট্রসচিব ও আইনসচিবকে ২৪ জুলাইের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন–সম্পর্কিত পদক্ষেপের বিষয়ে আদালতকে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ জুলাই অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে অবহিত করেন, আইন মন্ত্রণালয় ট্রাইব্যুনাল গঠন–সম্পর্কিত বিধানটি সংশোধনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে এবং আইন সংশোধনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
হাইকোর্টের রায়ে মাসুদকে স্থায়ী জামিন দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিন বহাল থাকবে। তবে আসামি কর্তৃক জামিনের সুযোগ অপব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট নিম্ন আদালত যেকোনো সময় আইন অনুযায়ী জামিন আদেশ বাতিল করতে পারবেন।
আইন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে বিচারাধীন মোট ১১ লাখ ৭১ হাজার মামলার মধ্যে ৩ লাখ ১২ হাজারই মাদক অপরাধের মামলা, যা মোট মামলার প্রায় ২৭ শতাংশ। অন্যদিকে, গত ১১ মাসে নতুন মাদক আইনে মামলার সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার।