নতুন পদ্ধতিতে কয়েক শ প্রশ্ন নিয়ে 'প্রশ্নব্যাংক'
• মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
• সভায় প্রশ্ন ফাঁসের সম্ভাব্য ছয় ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা।
• প্রশ্ন ফাঁসকারী চিহ্নিত হয়নি।
• আগামী এসএসসি নতুন পদ্ধতিতে।
• এমসিকিউ তুলে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে আগামী বছর নতুন পদ্ধতিতে এসএসসি পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই পদ্ধতিতে কয়েক শ প্রশ্ন নিয়ে একটি ‘প্রশ্নব্যাংক’ করা হবে। এরপর সেখান থেকে পরীক্ষার আগ মুহূর্তে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে।
একই সঙ্গে বহুনির্বাচনী প্রশ্নও (এমসিকিউ) তুলে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এমসিকিউ তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই মতকে তাঁরা নির্দেশ হিসেবেই দেখছেন।
একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সূত্রে জানা গেছে, চলতি এসএসসিসহ পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের সম্ভাব্য ছয়টি ক্ষেত্র নিয়ে সভায় আলোচনা হয়। কিন্তু কোথা থেকে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে কিংবা কারা করছে, তা নিয়ে কেবল পর্যালোচনাই হয়েছে। তবে ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কেউ সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। এর ফলে আগামী ২ এপ্রিল শুরু হতে যাওয়া এইচএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।
জানতে চাইলে সভায় অংশ নেওয়া একজন মন্ত্রী ও তিনজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী এইচএসসি পরীক্ষায় যাতে প্রশ্ন ফাঁস না হয়, সে জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা আরও সমন্বিতভাবে কাজ করার বিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, চলমান এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাবে না, এটা অনেকটা ধরে নিয়েই আগামী পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
১ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষার শুরু থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগাম ঘোষণা দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। সোমবার পর্যন্ত ১১টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। একাধিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের মতে, এবার যে মাত্রায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তা আগে কখনো হয়নি। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণাসহ এক ডজন উদ্যোগ নিলেও ফাঁস ঠেকাতে পারেনি। বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ালে আদালত সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব নির্ধারণ করে বিচারিক ও প্রশাসনিক দুটি পৃথক কমিটি গঠন করেছেন।
প্রশাসনিক কমিটির প্রধান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ। পরীক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তনের উদ্যোগের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে অনেক বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে একেকবার একেক ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অহরহ নতুন বই, নতুন নিয়ম, নতুন পরীক্ষাপদ্ধতি—এগুলো মানুষকে স্থিরতা দেয় না। গবেষণার মাধ্যমে পরিবর্তন করতে হবে, যা বেশ কিছুদিন চলবে। তিনি মনে করেন, যথেষ্ট পরিকল্পনা করে পরিবর্তনগুলো আনা হচ্ছে না।
‘প্রশ্নব্যাংক’ থেকে প্রশ্নপত্র করার বিষয়ে অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, এ বিষয়ে কয়েক বছর থেকেই আলোচনা হচ্ছে। তবে এই প্রশ্নব্যাংক কবে, কখন করা হবে সেটা ভেবেচিন্তে ঠিক করতে হবে।
গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বেলা সোয়া তিনটা থেকে শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আন্তমন্ত্রণালয়ের সভাটি শেষ হয়। এতে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ছয় সচিব ও বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সভায় চলতি এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পদক্ষেপ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে।
সভা শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আশা করছি আগামী বছর থেকে এসএসসি পরীক্ষা নতুন পদ্ধতিতে নিতে পারব।’ পদ্ধতিটি কী হবে, সেটা সুনির্দিষ্ট করে না বললেও সচিব বলেন, সবাই প্রশ্নব্যাংক করার বিষয়ে একমত হয়েছেন।
প্রশ্নব্যাংকের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষাসংক্রান্ত দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এখানে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, সংশোধন ও প্রশ্ন নির্বাচনের কাজটি একটি নির্দিষ্ট সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা হবে। ওই সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারীদের (শিক্ষক) কাছ থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে তা ‘প্রশ্নব্যাংকে’ রাখা হবে। সেখান থেকে প্রশ্নপত্রের সেট তৈরি হবে। একাধিক প্রশ্ন সেট অনলাইনে পরীক্ষার আগ মুহূর্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে পাঠানো হবে। সুরক্ষিত যন্ত্রের (ডিভাইস) মাধ্যমে এই কাজটি করা হবে।
বর্তমানে এসএসসিসহ পাবলিক পরীক্ষায় বিজি প্রেসে দুই সেট প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে পাঠানো হয়। পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে কেন্দ্রে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলার নিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো কেন্দ্রে এর আগেই প্যাকেট খোলা হয় এবং মুঠোফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে বাইরে পাঠিয়ে ফাঁস করা হয়।
এর আগেও ‘ডিজিটাল’ ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে পরীক্ষার দিন সকালে জেলা প্রশাসক বা উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ওই এলাকাতেই প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এমসিকিউ থাকবে না
বর্তমানে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে দুটি অংশ থাকে। একটিতে সৃজনশীল অংশ, যেখানে ৭০ শতাংশ নম্বর থাকে। আরেকটি অংশ এমসিকিউ, যেখানে ৩০ শতাংশ নম্বর থাকে। এখন অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষায় এমসিকিউ অংশের প্রশ্নই বেশি ফাঁস হচ্ছে। এ জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই পরীক্ষা থেকে এমসিকিউ উঠিয়ে দেওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এসসিকিউ উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে বলেছেন।
গতকালের সভা শেষে প্রশ্নের জবাবে সচিব সোহরাব হোসাইন বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলার পর এটা নির্দেশ হয়ে গেছে। এখন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি করা হবে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য ছয় ক্ষেত্র
গতকালের সভা উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে কার্যপত্র তৈরি করে, তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য ছয়টি ক্ষেত্রের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, বিজি প্রেসে প্রশ্নপত্র ছাপার কাজে অনেক লোক জড়িত থাকেন। তাঁরা প্রশ্ন কপি করতে না পারলেও স্মৃতিতে ধারণ করে নিয়ে আসতে পারেন। তিন থেকে চারজনের গ্রুপের পক্ষে এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে ট্রেজারি বা নিরাপত্তা হেফাজত থেকে প্রশ্নপত্র গ্রহণ করে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছানোর নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক কেন্দ্রে পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। তৃতীয়ত, অতিরিক্ত কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত জনবলের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া ভেন্যুগুলো (কেন্দ্রের অধীন অন্যান্য পরীক্ষার স্থান) বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মূল কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থিত। ফলে ৩০ মিনিট আগেই কেন্দ্রসচিব প্রশ্ন খুলতে বাধ্য হন। এখান থেকেও প্রশ্ন ফাঁসের আশঙ্কা আছে।
কার্যপত্রে আরও বলা হয়, পরীক্ষার্থী বা পরীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের স্মার্টফোন নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। গুটি কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে গোটা প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। অপরাধীদের তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার ও শাস্তি না দেওয়ায় অন্যরাও অপরাধ করতে ভয় পাচ্ছে না।
এ ছাড়া বিটিআরসির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন আপলোডকারীদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
সভা থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রযুক্তিগত সব সহায়তা দেওয়া হবে।
সভায় বলা হয়, চলতি এসএসসি পরীক্ষায় যা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, একটি অংশ আর্থিক লাভের জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাজে জড়িত। আরেকটি অংশ সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বেকায়দায় ফেলতে এসব করছে।