নতুন তিন মৎস্য অতিথি

আগুনচোখা

তিস্তাপারের মানুষেরা একে বলে আগুনচোখা। না, এটি কোনো বদরাগী মানুষের কথা বলা হচ্ছে না। তিস্তাপারের মানুষেরা তাদের খুবই প্রিয় একটি মাছকে রক্তলাল চোখের কারণে এই নামে ডাকে। তিস্তার পানি শুকিয়ে যেতে যেতে এই মাছও বিলুপ্ত হওয়ার পথে ছিল। দীর্ঘ দুই বছরের চেষ্টায় গত মে মাসে এই মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে বড় সাফল্য পেয়েছেন দেশের বিজ্ঞানীরা।

গত মার্চ থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়লে দেশের অনেক কিছুই স্থবির হয়ে যায়। কিন্তু নীলফামারীর সৈয়দপুরের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা বসে থাকেননি। তাঁরা মে মাসের মধ্যে মাছটির পোনা উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা করতে পেরেছিলেন। শুধু আগুনচোখা নয়, জাইত পুঁটি ও গজার মাছের পোনাও উৎপাদন করে কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পেয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরা।

ইফতেখার মাহমুদ

এই তিনটি সুস্বাদু ও জনপ্রিয় মাছের পোনা কৃত্রিমভাবে উৎপাদন করতে পারায় তা প্রথমত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেল বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। তবে এই মাছের ভোক্তা–অনুরাগীদের জন্য সুখবর হচ্ছে, এটি এখন থেকে পুকুর, বিল বা অন্য কোনো জলাশয়ে চাষ করা যাবে। অর্থাৎ শিং, মাগুর, পাবদা ও টেংরা মাছ যেমন এখন চাষিরা তাঁদের পুকুরে চাষ করতে পারেন। ফলে একসময় নদী ও ভোক্তার পাত থেকে হারাতে বসা ওই তিনটি মাছও ফিরে আসবে। শুধু নদীর ওপর নির্ভরশীল থাকবে না এর উৎপাদন। যে কেউ পোনা সংগ্রহ করে যেকোনো জলাশয়ে চাষ করতে পারবেন। উৎপাদন বাড়লে এর দামও কমে আসবে।

আগুনচোখা মাছটিকে অবশ্য অনেক এলাকায় আঙ্গুস নামে ডাকা হয়। রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে এই মাছ একসময় প্রচুর পাওয়া যেত।

সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা এই করোনাকালেও আরেকটি বড় কাজে হাত দিয়েছেন। দেশের ১৪৩ প্রজাতির দেশি মাছের একটি জীবন্ত জিন ব্যাংক স্থাপন করেছেন তাঁরা। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে গড়ে তোলা ওই জিন ব্যাংকে বর্তমানে ৮৫ প্রজাতির দেশি মাছ এরই মধ্যে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এর উদ্বোধন করেন। এই জিন ব্যাংক স্থাপনের ফলে ভবিষ্যতে এখন থেকে দেশি জাতের সব কটি মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

এরই মধ্যে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন উপকেন্দ্র রঙিন রানি মাছের পোনা উৎপাদনে বেশ এগিয়েছে। খুবই সুস্বাদু এই মাছ বাজার থেকে তো বটেই, দেশের জলাশয়গুলোতে বিরল হয়ে গেছে। একই সঙ্গে কাকিলা, বাতাসি, পিয়ালি, কাজলি, শালবাইম, ডেলা ও বোল মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। আগামী দু–এক বছরের মধ্যে এসব মাছও চাষিরা পুকুরে চাষ করতে পারবেন বলে সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা আশা করছেন।

তিনটি মাছের ফিরে আসা

আগুনচোখা মাছটিকে অবশ্য অনেক এলাকায় আঙ্গুস নামে ডাকা হয়। রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে এই মাছ একসময় প্রচুর পাওয়া যেত। এখনো মাঝেমধ্যে তিস্তার পানি বাড়লে লাল চোখের মাছটি তীরের কাছে ভেসে আসে। একসময় সিলেট ও হাওর অঞ্চলেও পাওয়া যেত। নদীতে পলি পড়ায় ও দূষণের কারণে এই মাছ কমে আসে। নদীতে এখন মাছটি ১০০ থেকে ২০০ গ্রাম ওজনের পাওয়া যায়। তবে পুকুরে চাষের সময় ভালো খাবার ও পরিবেশ পেলে তা ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হবে বলে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।

মেঘনা ও যমুনা নদীতে আগে হরহামেশা গজার মাছ পাওয়া যেত। এটিও মূলত দূষণের কারণে কমে এসেছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা এর পোনা উৎপাদনের জন্য কাজ করে আসছিলেন। করোনার পুরো সময়ে তাঁরা নিরবচ্ছিন্নভাবে এ নিয়ে গবেষণা করেন। অবশেষে গত সেপ্টেম্বর মাসে এল কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।

জাইত পুঁটি মাছ অবশ্য গজার ও আগুনচোখার মতো অতটা দুর্লভ ছিল না। সারা দেশেই বিল-জলাশয়, নদী ও প্লাবন ভূমিতে পাওয়া যেত। দেশের গ্রামীণ জনপদের মানুষের খাদ্যতালিকায় এটি ছিল অন্যতম পছন্দের মাছ। মূলত দূষণের কারণে এর উৎপাদনও বেশ কমে আসে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘করোনাকালে আমাদের বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণা বন্ধ রাখেননি, বরং আরও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরা এই সময়টাকে কাজে লাগিয়েছেন। গত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাঁরা তিনটি মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফেলেছেন। আশা করি, আরও যে আট-দশটি জাত নিয়ে আমরা কাজ করছি, তার পোনাও দ্রুত উৎপাদন করা যাবে।’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে দেশি মাছের উৎপাদন ১২ বছরে চার গুণ বেড়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় আড়াই লাখ টন দেশি মাছ উৎপাদিত হয়। স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের হিসাবে, বাংলাদেশে স্বাদুপানির মোট ২৬০টি প্রজাতি রয়েছে। এর মধ্যে ১৪৩টি ছোট দেশি প্রজাতির। যার মধ্যে ৬৪টি প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায়। এসব বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য মূলত এই জিন ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে।


ইফতেখার মাহমুদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক