নজরুলসংগীতের অনিবার্য কণ্ঠস্বর

ফিরোজা বেগম
প্রথম আলো

কাজী নজরুল ইসলামের ‘নাচে ইরানি মেয়ে নাচে’ গানটির প্রসঙ্গ এলে আমাদের কেবল একটি মুখই মনে ভেসে ওঠে। তিনি ফিরোজা বেগম। তাঁকে উপমহাদেশীয় সংগীতের রাজেন্দ্রাণী বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হয় না। সংগীতের নানা শাখায় অনায়াস গতায়াত থাকলেও তিনি গেয়েছেন কেবল নজরুলের গান। নজরুল ইসলামের লেখা আধুনিক গান থেকে ‘নজরুলসংগীত’ হিসেবে যে স্বীকৃতি পেল, এর পেছনে এই কিংবদন্তি শিল্পীর অবদান অনস্বীকার্য। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নজরুলের গানের অনুষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর একক প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি রাজি হয় তাঁর গলায় নজরুলের গান রেকর্ড করতে। তিনি গেয়েছিলেন, ‘আমি গগন গহনে সন্ধ্যাতারা...’। পূজার রেকর্ডের ক্ষেত্রেও তাই। তিনি বারংবার প্রত্যাখ্যাত হলেও শেষ পর্যন্ত হার মানে কোম্পানি। রাজি হয় পূজায় তাঁর গাওয়া নজরুলসংগীতের রেকর্ড বাজারে ছাড়তে। আবার ১৯৬১ সালে ফিরোজা বেগমের গাওয়া ‘মোর ঘুম ঘোরে’ আর ‘নিরজনে সখি’ দিয়ে বেরোয় লং প্লেয়িং রেকর্ড। সেটা ছিল নজরুলের গানের প্রথম লং প্লে। একইভাবে ১৯৬৭-৮৬তে পাকিস্তানেও প্রথম নজরুলের গানের লং প্লে তাঁরই। ওই রেকর্ডে ছিল ‘ওরে শুভ্রবসনা রজনীগন্ধা’। এমনকি গজলের প্রথম লং প্লেও ফিরোজা বেগমের। ১৯৬৮ সালে এক সপ্তাহের মধ্যে ২ লাখ কপি বিক্রি হয়ে যায় তাঁর গাওয়া ‘শাওন রাতে যদি’র রেকর্ড। এ জন্য জাপানের সনি করপোরেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সিবিএস এই গায়িকাকে গোল্ড ডিস্ক দিয়ে সম্মানিত করেছিল।

কবির উপলব্ধিকে আত্মস্থ করে তবেই তা পুনর্ব্যক্ত করার মন্ত্রে বিশ্বাস করতেন ফিরোজা বেগম। এভাবে ছয় দশকেরও বেশি সময়ের আত্মনিবেদনে তিনি হয়ে ওঠেন নজরুলসংগীতের অনিবার্য কণ্ঠস্বর।

১৯৩০ সালের শ্রাবণের এক পূর্ণিমা রাতে জন্ম বলে অনেকেই তাঁকে ‘শ্রাবণী’ বলে ডাকতেন। আবার ‘আনার’ বা ‘আসমানি’ও ডাকা হতো গায়ের টুকটুকে ফর্সা রংয়ের কারণে। একেবারেই অন্তর্মুখী ফিরোজার বসবাস ছিল তাঁর নিজের জগতে। পড়ালেখা, খেলাধুলা, গান, অভিনয়, আঁকাকষা, নাচ—সবই তিনি করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। এমনকি মহেশ ছায়াছবিতে আমিনার ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাবও ছিল। তিনি সাড়া দেননি।

বাড়িতে গান শোনার রেওয়াজই ফিরোজাকে গানের প্রতি অনুরক্ত করে তোলে। বাড়িতে থাকা কিছু রেকর্ড আর গ্রামোফোনই হয়েছিল তাঁর প্রথম সংগীতসঙ্গী। হঠাৎ কখনো কোন গান মাথায় এলে তুলে নিতেন ঠিকঠাক। কিন্তু পাছে অন্যরা বিরক্ত হন, তাই আড়ালে গিয়ে গলা ছেড়ে গাইতেন। কলকাতায় থাকার সময়ে বাড়িতে মেহমান এলে তিনি বাড়ির অদূরে নির্মিত ট্রেঞ্চের ভেতরে বসেই রেওয়াজ করতেন।

কিশোরবেলায় একবার মামার সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে এক আসরে কাজী নজরুল ইসলামকে গান শোনানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তারিফও আদায় করে নেন। বড় চুলওয়ালা, টুপি পরা আসরের মধ্যমণিকে তাঁর তখন চেনার কথা নয়, চেনেনওনি; বরং মামা পরে তাঁকে বিষয়টি জানান। সেদিন তাঁর গান শুনে স্বয়ং নজরুল বলেছিলেন, ‘এ গান তুমি শিখলে কোত্থেকে?’ ফিরোজার জবাব ছিল, ‘বড় বড় কালো রেকর্ড শুনে।’ সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের একটি মেয়ে গান গাইছে, গান গাইতে চায়—জেনে সেদিন দারুণ খুশি হয়েছিলেন নজরুল। এমন জাত শিল্পীকে চিনতে কবির একটুও ভুল হয়নি।—ফিরোজা বেগমের জীবনের এসব খুঁটিনাটি এ লেখকের জানার সুযোগ হয়েছিল তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে। তখন জেনেছিলাম, ১৯৪৮-৪৯ সালে ফিরোজা বেগম আর তালাত মাহমুদকে অতিথি শিল্পী হিসেবে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। তাঁদের গানেই উদ্বোধন করা হয় ঢাকা রেডিওর শর্ট ওয়েভ। এর কিছুদিন আগে ১৯৩৯ সালে অডিশন দিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিওর শিশুদের অনুষ্ঠান শিশুমহলে সুযোগ পেয়ে যান ফিরোজা। তবে স্থায়ীভাবে কলকাতায় থাকতে না পারা তাঁর গান শেখার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়েছে। ১৯৪২ সালে ১২ বছর বয়সে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে বের হয় ফিরোজার প্রথম রের্কড। এখানে চিত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে গেয়েছিলেন ইসলামি গান ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’। এদিকে তাঁর বড় বোন ও ভগ্নিপতি দিল্লি থেকে স্থায়ীভাবে কলকাতায় আসার পর তাঁদের বালিগঞ্জের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। ওই সময়ে টানা চার বছর গান শিখেছেন ছোট্ট ফিরোজা। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তাঁকে ফিরে আসতে হলো ফরিদপুরে। আর এ সময় গান শেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানসিক পীড়নে অসুস্থও হয়ে পড়লেন তিনি। পরে কলকাতায় ফিরে কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে ‘ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ’ আর ‘প্রীত শিখানে আয়া’—এই দুটি উর্দু গান রেকর্ড করলেন।

বেশ কম বয়সেই ফিরোজা বেগমের চারটি রেকর্ড বের হলেও গান শেখার ইচ্ছা অবদমিত হয়নি কোনোদিনই। শিখেছেন চিত্ত রায় আর কমল দাশগুপ্তের কাছে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৭ টানা ১৩ বছর ছিলেন কলকাতায়। পরিবার মেনে নিতে না পারলেও ১৯৫৬ সালে সুরকার কমল দাশগুপ্তকে বিয়ে করেন। কলকাতাতেই জন্মেছে তাঁর তিন সন্তান—তাহসীন আহমেদ, হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ। ওই সময়টা ছিল স্বর্ণকণ্ঠী ফিরোজা বেগমের স্বর্ণযুগ। অথচ টানা পাঁচ বছর স্বামী-সন্তান-সংসার সামলাতে গিয়ে গান গাইতে পারেননি তিনি। আজীবন এই ঘটনা এক নিদারুণ কষ্টের বোধে আচ্ছন্ন করেছে তাঁকে।

নজরুলসংগীতের বাইরে অন্য গানের রেকর্ড বেশি না থাকলেও রবীন্দ্রসংগীতের একটা রেকর্ড আছে তাঁর। শান্তিদেব ঘোষের অনুমতিতেই সেই গান রেকর্ড হয়। এই রেকর্ড শুনে মুগ্ধ পঙ্কজ মল্লিক রবীন্দ্রসংগীত শেখানোর জন্য চলে এসেছিলেন তাঁর কলকাতার বাড়িতে।

সেই ১২ বছর বয়সে রেকর্ড বের হলেও ১৯৭২ সালের আগে ফিরোজা বেগম কখনো মঞ্চে ওঠেননি। ১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর কলকাতার রবীন্দ্রসদনে জনসমক্ষে প্রথম তিনি সংগীত পরিবেশন করেন। সেটাই ছিল সেখানে কোনো শিল্পীর প্রথম কোনো একক অনুষ্ঠান। ওই আসর নিয়ে অন্তত এক পক্ষকাল লেখালেখি হয়েছে। ওই সময়ের আগে তাঁর কোনো ছবি রেকর্ডেও ছাপা হতো না। এর অনুমতিই ছিল না। খ্যাতিকে সব সময়েই নিরাপদ দূরত্বে রেখেছিলেন। এ জন্যই হয়তো বলতে পেরেছিলেন, ‘আমি আছি আর আছে মোর তানপুরা’। বিত্তের পেছনে তিনি ছোটেননি বলেই সারা জীবন প্লেব্যাকের মোহ থেকেও নিজেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ফিরোজা বেগম ছিলেন অসম্ভব সাহসী আর অকুতোভয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধন। সব কিছু থোড়াই কেয়ার করে তিনি আগে বাংলা, পরে উর্দু গান গেয়েছিলেন। সেই সময়ের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বাধ্য হয়েছিলেন ফিরোজার শর্ত মানতে। সেদিন তিনি গেয়েছিলেন, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’।

এর পর সত্তর দশকের উত্তাল সময়ে করাচিতে, ইএমআই পাকিস্তানে তিনি রেকর্ড করেন বাংলা গান। ‘জয়, জয়, জয় বাংলার জয়’ আর ‘জন্ম আমার ধন্য হল মাগো’। এই গান গাওয়ার ‘অপরাধে’ দেশে ফেরার পর একদিন পর তাঁকে রেডিও স্টেশন থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর রাত একটায় নামিয়ে দিয়ে যাওয়া হয় বাসায়। তিনি তাঁদের যুক্তি দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হলেও মূল রেকর্ডটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর অন্য শিল্পী ওই গান রেকর্ড করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাধিকবার তাঁর বাড়ি তল্লাশি করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে তাঁকে মেরে ফেলার। ১৪ ডিসেম্বর তো একটুর জন্য বেঁচে যান তিনি!

এই সংগীতসম্রাজ্ঞীর জীবন কখনোই ছিল না কুসুম বিছানো। প্রতিকূলতার সঙ্গে বারবার লড়েছেন। যদিও স্বাধীনতা পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননায় তাঁকে ভূষিত করা হয়েছে, তবুও একটা প্রশ্ন থেকেই হয়ে যায়: দেশ কি তাঁকে যথাযথ সম্মান দিতে পেরেছে? বিস্ময় জাগে, ভারত আর পাকিস্তান মিলিয়ে যেখানে এই কিংবদন্তির রেকর্ডসংখ্যা ১৬০০, সেখানে বাংলাদেশে হাতে গোনা তিন কি চারটি। একনাগাড়ে ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় সংগীত সাধনার নজির পৃথিবীতে খুব কম শিল্পীরই আছে।

তিনি চেয়েছিলেন নজরুল ইনস্টিটিউট হোক পান্থপথে। কিন্তু হয়নি; বরং তাঁকে নজরুল ভবন থেকে সরিয়ে সেখানেই ভিত্তি স্থাপন করা হয়। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁকে অনুরোধ করেও অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারতাম।

ফিরোজা বেগম নামের এই সুর–তাপসীকে স্টাইল আইকন অভিহিত করলে একটুও বাড়িয়ে বলা হয় না। ছেলেবেলা থেকেই পোশাক–আশাকের ব্যাপারে ছিলেন সচেতন। পুরোনো ছবিগুলোতে বাঙ্‌ময় তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভা। অথচ অনুকরণীয় নৈপুণ্যে, নিভৃত যতনে প্রচারের উজ্জ্বল আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন সব সময়। পাদপ্রদীপের আলোয় কেবল খেলা করে জ্যোৎস্নার মতো নরম অথচ হৃদয়ছোঁয়া তাঁর কণ্ঠমাধুর্য। সবকিছুর উর্ধে নিয়ম করে অমৃত্যু রেওয়াজই করে গেছেন। নজরুলের গান, হৃদয়পাত্র উছলে পড়া মাধুরীময় স্মৃতিরাজি নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের শেষদিনগুলো। আর আজও সেই সুরের ইন্দ্রজালে সম্মোহিত হন তাঁর অনুরাগীরা।

শেখ সাইফুর রহমান সাংবাদিক