দীর্ঘস্থায়ী, ব্যাপক এবং এক অজানা ধরনের ধাক্কা দিয়েছে কোভিড-১৯। এর অভিঘাত পড়েছে সর্বত্র। বিপুল প্রভাব সৃষ্টিকারী কোভিড আমাদের প্রচলিত উন্নয়ন চিন্তাকেও আলোড়িত করেছে। তাগিদ দিয়েছে নতুন ভাবনার।
বন্যা বা ভাঙনের মতো দুর্যোগের পর দরিদ্র মানুষকে ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো শহরাঞ্চলে ভিড় করতে দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। করোনার ধাক্কায় ভিন্ন ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। করোনার শুরু থেকেই এর আর্থসামাজিক প্রভাব নিয়ে কাজ করছি আমরা। আমাদের গবেষণার তথ্য, করোনাকালে রাজধানীসহ শহর অঞ্চল ছেড়ে গেছে অন্তত ১৬ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। শুরুতেই বলেছিলাম, করোনার বহুমাত্রিক প্রভাব প্রচলিত ভাবনাকে আঘাত করেছে। শহর থেকে মানুষদের চলে যাওয়া এর একটি উদাহরণ। কারণ, ভাগ্যের অন্বেষণে গ্রাম থেকে শহরমুখী হয় মানুষ। আমাদের আর্থসামাজিক বাস্তবতা এটাই। এসব মানুষ শহরে এসে কিছুটা হালও ফেরাতে পেরেছিল। কিন্তু মহামারি করোনা সবকিছু পাল্টেৃ দিয়েছে। একসময় গ্রাম থেকে একটু ভালো করে বাঁচার আশায় যারা শহরে এসেছিল, তারা আবার হয়েছে গ্রামমুখী। এই উল্টো অভিবাসন করোনাকালে এক জটিল প্রপঞ্চের মুখে ফেলেছে আমাদের। এ ধাক্কা দীর্ঘস্থায়ী কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এত তাড়াতাড়ি দেওয়া যাবে না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমাদের নগরায়ণপ্রক্রিয়া কতটুকু দরিদ্রবান্ধব, সেই প্রশ্ন এখনই করা যায়।
এই করোনাকালে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কারচুপি উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থনৈতিক কৌশলের ঘাটতি স্পষ্ট হয়েছে। আর দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচলিত ধারণাও ধাক্কা খেয়েছে ব্যাপকভাবে। কোভিড আমাদের দেখিয়েছে, আমাদের নীতি-ভাবনায় একধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারচুপি আছে। এখানে দরিদ্রদের একটা বোঝা হিসেবে দেখা হয়। এদের দায় কেউ নেয় না। কিন্তু তাদের ছাড়া চলবেও না। আজই যদি পোশাক কারখানার সব শ্রমিক শহর ছেড়ে চলে যেতে চায়, তবে এই শিল্প বসে যাবে। আমরা কারখানার শ্রমিককে তার মজুরিটাই শুধু দিতে রাজি আছি, কিন্তু তার একটা সুস্থ সামাজিক জীবন তৈরিতে রাজি নই। তার আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এমনকি তার চলাফেরায় সহায়তা করতে রাজি নই। দৃষ্টিভঙ্গির এই কারচুপির খেলা চলছে অনেক দিন ধরে। কোভিডে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটল। মানুষগুলো টিকতে পারল না। ফিরে গেল সেখানে, উন্মুল হয়ে চলে এসেছিল যেখান থেকে। শুরু হলো আবারও অনিশ্চিত অভিযাত্রা।
কোভিড পরিস্থিতি সামগ্রিক অর্থনৈতিক কৌশলের ঘাটতিকে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে শিক্ষায় দুটি জগৎ তৈরি করেছি। নিম্নমানের শিক্ষার মহাসমুদ্রের মধ্যে গুটিকয় উৎকর্ষের দ্বীপ তৈরি করেছি। সেই সুযোগ-সুবিধার দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছেই থেকে যাচ্ছে লোভনীয় চাকরিগুলো।
আমাদের গবেষণায় আমরা দেখেছি, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, যোগাযোগের ব্যয় এবং অন্য নানামুখী ব্যয় মেটাতে না পেরেই এসব মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। আন্তর্জাতিক নানা মানদণ্ডে ঢাকা একটি ব্যয়বহুল শহর। আমি একটি কথা ইংরেজিতে বললে বেশ ভালো শোনাবে মনে হয়, ‘ইট ইজ এক্সপেনসিভ টু বি পুওর ইন ঢাকা’। অর্থাৎ ঢাকায় দরিদ্র হওয়াও খরচের ব্যাপার। গ্রামে মানুষের কিছু সহজাত সংস্থানের জায়গা থাকে। শহরে তা অনুপস্থিত। করোনাকাল সুপ্ত প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। আর তা হলো, নগরে জীবনযাপনের ব্যয় কেন এত বেশি হতে হবে?
নগরের দরিদ্র মানুষের জীবনযাপনের ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের এক চরম অসামঞ্জস্য দেখি। এর সঙ্গে আমাদের সামগ্রিক এলিট–নিয়ন্ত্রিত বাসস্থানের নীতি দায়ী। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে দরিদ্র মানুষেরা কোনো বিষয় নয়। দরিদ্র মানুষের আবাসনের জন্য সরকারি উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে। ভাষানটেক এর উদাহরণ।
করোনাকালে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কারচুপি উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থনৈতিক কৌশলের ঘাটতি স্পষ্ট হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচলিত ধারণাও ধাক্কা খেয়েছে ব্যাপকভাবে।
আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যবহির্ভূত সামগ্রীর দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে। আর খাদ্যের কথাও যদি বলি, সেখানে দেখব যে আমাদের সামগ্রিক দৃষ্টি চালের ওপর। যদিও এখন এর দাম বেশ চড়া। চালের বাইরে পুষ্টি একটা বিবেচ্য বিষয়। গরিবের খাদ্যের ক্ষেত্রে পুষ্টি আলোচনা অনুপস্থিত।
কোভিড পরিস্থিতি সামগ্রিক অর্থনৈতিক কৌশলের ঘাটতিকে দেখিয়ে দিচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে শিক্ষায় দুটি জগৎ তৈরি করেছি। নিম্নমানের শিক্ষার মহাসমুদ্রের মধ্যে গুটিকয় উৎকর্ষের দ্বীপ তৈরি করেছি। সেই সুযোগ-সুবিধার দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছেই থেকে যাচ্ছে লোভনীয় চাকরিগুলো। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে দাবি করা হয়, তা মূলত নিম্নমানের মহাসমুদ্রের মানুষের জন্য। যেমন পোশাকশিল্পে শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা উৎসাহের সঙ্গে বলতে শুনি। এ শিল্পে বেশি বেতনের চাকরিগুলোতে এই মহাসমুদ্রের বাসিন্দারা ব্রাত্য। করোনা দেখাল, এই নিম্নমানের সাগরে ভাসা মানুষগুলোর টিকে থাকার ক্ষমতা কত নড়বড়ে। দুঃসময়ে তাই তারা নগর ছাড়ল বা ছাড়তে বাধ্য হলো।
আমাদের অর্থনৈতিক কৌশলের আরেক সীমাবদ্ধতা হলো এখানে মধ্যম অর্থনীতিতে নজরের অভাব। শুধু সরকারি স্তরে নয়, অর্থনীতিবিদদেরও এ নিয়ে আগ্রহ কম। এই মধ্যম অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ পরিষেবা খাত। এই খাতগুলোয় কোনো সুরক্ষার পরিবেশ নেই। নীতিসহায়তা ও চিন্তাগুলো তৈরি পোশাক খাতের মতো সামষ্টিক অর্থনীতিকে ঘিরেই আবর্তিত। এবার কোভিডকালে নীতিসহায়তার সিংহভাগ গেছে এসব খাতে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যে প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা আছে, তা প্রচলিত কঠোর নিয়মের বেড়াজালে বন্দী।
আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা এসএমই নীতির কথা ধরতে পারি। এখানে দেখা যাবে, যারা আগে থেকে সুবিধা পাচ্ছিল, তারাই পাচ্ছে। এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুল মানুষের ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারেই সীমিত। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের কথা ধরতে পারি। এখানে কোনো কোনো সার্ভিসের চার্জ এত বেশি হওয়া উচিত কি না, তা আলোচনার দাবি রাখে। মধ্যম অর্থনীতির দুটি সমস্যা আছে। একটি হলো, এখানে নীতিসহায়তা নেই। আরেকটি হলো, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণমূলক নিষ্পেষণ। পুলিশের বাড়াবাড়ি, মাস্তানদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণমূলক নিষ্পেষণের দুই উদাহরণ।
করোনাকাল আমাদের দারিদ্র্যভাবনাকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। সরকারি স্তরে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করলেই একধরনের আত্মতৃপ্তির অভিব্যক্তি দেখা গেছে। কিন্তু দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করার বিষয়টি তো একটি পরিসংখ্যানগত বিষয়। তাই সীমা অতিক্রম করার আলোচনার প্রাবল্যে এর ওপরের যে ভঙ্গুর অবস্থা, তার দিকে কিন্তু এত দিন দৃষ্টি ছিল না। দারিদ্র্যসীমার ওপরে অন্তত দুটি শ্রেণিকে চিহ্নিত করতে হবে। একটি সচ্ছল শ্রেণি, অন্যটি নিম্নমধ্যবিত্ত বা স্বল্প আয়ের মানুষ। কোভিডের ধাক্কায় দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষেরা আর টিকতে পারেনি নগরে। জীবনযাত্রার প্রবল ব্যয় মানুষগুলোকে চলে যেতে বাধ্য করে। আমাদের কাঠামোর নিচে যে বড় ধরনের ফাটল ছিল, সেগুলো সামনে চলে এসেছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রগতি বলতে আমরা কী বুঝব, সেই বোঝার ক্ষেত্রে একটি ধাক্কা দিয়েছে কোভিড। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার পর নগরে ফিরতে শুরু করেছে শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে বড় বড় চ্যালেঞ্জ আছে। অন্যতম চ্যালেঞ্জ, স্বল্প সময়ে এবং আরও বড় করে নগর কর্মসংস্থানের সম্প্রসারণ কীভাবে করা যায়, তার দিকে দৃষ্টি দেওয়া। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি ও নগদ অর্থ দেওয়ার উদ্যোগ এখানে চালু করা যেতে পারে। মধ্যম অর্থনীতিকে কীভাবে নীতিসহায়তা দেওয়া যায়, ভাবতে হবে তা নিয়ে।
এই সময়ে অর্থনৈতিক কৌশল নির্মাণের পদ্ধতির বিনির্মাণ দরকার। আমরা কৌশল নির্মাণ করছি বিশেষজ্ঞ ও আমলাদের সমন্বয়ে। নিবিড়ভাবে মাঠের সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে কৌশল ঠিক করতে হবে। তথাকথিত অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার যে কথা বলা হয়, সেখানে বেশ ফাঁক আছে। অংশগ্রহণের ভিত্তিটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একরৈখিক। যাঁরা বিশেষজ্ঞ ও আমলা, তাঁরা বক্তব্য দেন শ্রোতাদের উদ্দেশে। আমাদের কাছে অংশগ্রহণের অর্থ এত দিন ছিল, আমরা শ্রোতা হিসেবে তাদের চেয়েছি। এখন যাঁরা নীতি নির্ধারণ করছেন, তাঁদের শ্রোতা হতে হবে। সাধারণ মানুষকে বক্তা হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কৃষির নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। দরকার গ্রামীণ অকৃষি খাতের বিকাশ।
আমাদের নগর নিরাপত্তাজাল কর্মসূচিকে বড় আকারে সাজাতে হবে। নিরাপত্তাজাল ও সিঁড়ি—এই দুয়ের সংমিশ্রণে এক নতুন কৌশল দরকার। দারিদ্র্যের আঘাতে যেন পড়ে না যায়, তার জন্য জাল দরকার। আর শুধু টিকে থাকা নয়, যেন ওপরে উঠতে পারে, সেই জন্য সিঁড়ির দরকার। নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধাক্কা দেওয়া দরকার। শুধু কোভিডের জন্য নয়, আরও দরিদ্র করে দেওয়ার প্রবণতা থামাতে এবং সার্বিক অর্থনীতির বিকাশেই এর সম্প্রসারণ দরকার। নগরছাড়া মানুষগুলোকে নগরে ফেরাতে হবে। তাদের যেন আর ফিরে যেতে না হয়, তার ব্যবস্থা জরুরি।
● হোসেন জিল্লুর রহমান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা