ধান ভানতে শিবের গীত নয়

১ অক্টোবর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্​যাপন করল। আগামী বছর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্​যাপন করবে বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চাল আর গত এই ৫০ বছর ছিল বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য উত্পাদনে এক দীর্ঘ সাফল্যের ইতিহাস। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতাসংগ্রামে লিপ্ত, তখন ৭ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টন চাল উত্পাদনের সক্ষমতা ছিল। আজ এত বছর পর এ দেশের জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৭ কোটি হলেও চালের উত্পাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি। বর্তমানে ৩ কোটি ৬০ লাখ টনের বেশি। আর আমাদের মনে রাখতে হবে যে তা সম্ভব হয়েছে প্রধানত ধানবিজ্ঞানীদের অধিক উত্পাদনশীল জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে। সঙ্গে অবশ্যই ভূমিকা ছিল মেহনতি কৃষকের। আর সরকারের সঠিক নীতি–সহায়তার।

বর্ধিত উত্পাদন কিন্তু এসেছে ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমি থেকে। বাড়িঘর, শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনে বিগত পাঁচ দশকে অনেক কৃষিজমি আমরা হারিয়েছি। কিন্তু কৃষিবিজ্ঞানের উন্নয়নের কল্যাণে আমাদের উত্পাদন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে ১০৫টি উচ্চফলনশীল (উফশী) ও হাইব্রিড ধানের জাত উন্নয়ন করেছে ব্রি এবং এই জাতগুলো থেকেই দেশের মোট চালের ৮৫ শতাংশ উত্পাদিত হয়ে থাকে। আর বাকিটা আসে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী জাতগুলো থেকে।

করোনাকালেও থামেনি গবেষণা

গত মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এপ্রিল থেকে একের পর এক সরকারি–বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম গুটিয়ে আসতে থাকে। তখনো দেশের ধানবিজ্ঞানীরা তাঁদের কার্যক্রম বন্ধ রাখেননি। গাজীপুরে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়সহ সব উপকেন্দ্রেও ধানের নিত্যনতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণা পুরোদমে চলেছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে ব্রি উদ্ভাবিত তিনটি উচ্চফলনশীল ধানের জাত অনুমোদন করেছে জাতীয় বীজ বোর্ড। যদিও এই জাতগুলোর গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল বছর আটেক আগে। কিন্তু এই বছরে এসে তা জাত হিসেবে অনুমোদনের চূড়ান্ত ধাপ অতিক্রম করে। এই শেষ সময়ে এসে করোনার ভয় আর আতঙ্ক মাথায় নিয়েই শেষ সময়ের কাজগুলো সংস্থাটির বিজ্ঞানীদের করতে হয়েছে।

ধানের নতুন ওই জাতগুলোর শেষ সময়ের অনেক কাজ তখনই করতে হয়েছে। করোনার কারণে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান যখন বন্ধ ছিল, তখনো তাদের কাজ চলেছে নিয়মিত।

উফশী জাত দুটির গবেষণার সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীদের অনেককেই করোনার মধ্যেই গবেষণাগারে যাতায়াত করতে হয়েছে। ধানের নতুন ওই জাতগুলোর শেষ সময়ের অনেক কাজ তখনই করতে হয়েছে। করোনার কারণে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান যখন বন্ধ ছিল, তখনো তাদের কাজ চলেছে নিয়মিত।

নতুন ধানগুলোর মধ্যে বোরো মৌসুমের লবণসহিষ্ণু দুটি ও আউশ মৌসুমে চাষাবাদের উপযোগী একটি জাত রয়েছে। এর মধ্যে ব্রি ধান-৯৭ ও ব্রি ধান-৯৯ দেশের উপকূলীয় লবণাক্ততা অঞ্চলের জন্য ও অনুকূল পরিবেশে আবাদের জন্য এবং ব্রি ধান-৯৮ সারা দেশে আউশ মৌসুমে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করা হয়। নতুন এই তিনটি জাত উদ্ভাবনের ফলে ব্রি উদ্ভাবিত মোট ধান জাতের সংখ্যা হলো ১০৫।

ব্রির মতো আমরাও আশা করছি, এই জাতগুলো কৃষকের হাতে পৌঁছালে তা দেশের খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াবে। দেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে বছরে একটিমাত্র ফসল হয়। ব্রির বিজ্ঞানীরা ওই লবণসহিষ্ণু বেশ কটি জাত এর আগেও উদ্ভাবন করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে দেশের উপকূলে যখন লবণাক্ততা বাড়ছে, তখন এই জাতগুলোই কৃষকের জীবিকা ধরে রাখার সবচেয়ে বড় অবলম্বন হয়ে উঠছে।

নতুন জাতের ব্রি ধান-৯৯
ছবি: খালেদ সরকার

১ টাকায় ৪৬ টাকা লাভ

ধানবিজ্ঞানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ১ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে লাভ এসেছে ৪৬ টাকা। ফলে আমরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করতে পেরেছি। সেচনির্ভর বোরো ধানের ৮২ শতাংশ এখন উত্পাদিত হচ্ছে ব্রির উফশী জাতগুলো থেকে। আমনে এই হার ৪৭ শতাংশ এবং আউশ ধানে ৩৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) সহযোগিতায় আমরা ভিটামিন এ-সমৃদ্ধ ‘গোল্ডেন রাইস’-এর জাতও উন্নয়ন করেছি। কিন্তু রক্ষণশীল নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার কারণে সে জাত এখনো বাংলাদেশ অনুমোদন করেনি, যদিও ফিলিপাইন তা অনুমোদন করেছে।

ইরি ও ব্রি যৌথভাবে ধানের জাতগুলোর মধ্যে কিছুটা পরিমাণ হলেও ভিটামিন, আয়রন ও জিংক দিয়ে সমৃদ্ধ করে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে পাঁচটি জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত বাজারে ছেড়েছে, যা বর্তমানে দেশের ৩২টি জেলার কৃষকেরা চাষ করছেন। এসব জাতের উৎপাদন বাড়লে এবং চাল সহজলভ্য হলে তা দেশের পুষ্টি সমস্যায়ও বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।


রিয়াজ আহমদ ঢাকা ট্রিবিউন–এর নির্বাহী সম্পাদক