ধরা না দিয়ে সাইফুলকে আত্মঘাতী হতে বলেছিলেন আকরাম

জঙ্গি আকরাম হোসেন খান ও আত্মঘাতী জঙ্গি সাইফুল
জঙ্গি আকরাম হোসেন খান ও আত্মঘাতী জঙ্গি সাইফুল

নব্য জেএমবির জঙ্গি সাইফুল ইসলাম আত্মঘাতী হন ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন তিনি অবস্থান করছিলেন পান্থপথে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালের চতুর্থ তলার ৩০১ নম্বর কক্ষে। 

সেদিন আত্মঘাতী হওয়ার আগে দিবাগত রাত ৩টা ৩১ মিনিটে নব্য জেএমবির একাংশের আমির আকরাম হোসেন খান নিলয়কে মুঠোফোনে খুদে বার্তা দিয়ে জঙ্গি সাইফুল বলেন, ‘পুলিশ রেড পড়েছে। বাইরে থেকে পুলিশ আমার ডোর (দরজা) লক (বন্ধ) করে দিয়ে গেছে। আমি বোমা নিয়ে বসে আছি। আমি ধরা দিতে চাই না।’

ভোররাত ৪টা ৪ মিনিটে আকরাম হোসেন ফিরতি খুদে বার্তা দিয়ে সাইফুলকে বলেন, ‘দেবেন না। সুইচ থেকে স্কচটেপ আর পিন খুলে রেডি হয়ে থাকেন। বের হতে পারলে কাফিরদের মাঝে ফাটিয়ে দেবেন। আর সুইচের পিন খুলেছেন তো?’


জবাবে সাইফুল খুদে বার্তা দিয়ে আকরামকে বলেন, ‘জি, সুইচ দুইটা একসঙ্গে টিপ দেব।’

২০১৭ সালের গত ১৫ আগস্ট ধানমন্ডিতে জাতীয় শোক দিবসের র‍্যালিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পরিকল্পনার করেছিল। হামলার আগে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়ক একাধিকবার রেকি করে আসেন জঙ্গিরা। হামলা করার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েই জঙ্গি সাইফুল পান্থপথে হোটেল অলিও ইন্টারন্যাশনালে ওঠেন। তাঁর কাছে ছিল শক্তিশালী বোমা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আগেই হামলাকারী জঙ্গির অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হন। রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে অভিযান চালান। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে জঙ্গি সাইফুল আত্মঘাতী হন। এ ঘটনায় পুলিশ কলাবাগান থানায় একটি মামলা করে।

সম্প্রতি এ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম বিভাগ। অভিযোগপত্র থেকে জঙ্গি সাইফুল ও আকরামের মুঠোফোনের এই বার্তা পাওয়া গেছে। মামলাটি শিগগিরই সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য পাঠানো হবে।

পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের র‍্যালিতে হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী হলেন নব্য জেএমবির একাংশের আমির আকরাম হোসেন খান। তাঁর নেতৃত্বে নব্য জেএমবির ১৫ জন সদস্য হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জড়িত ছিলেন। আকরাম হোসেন খানের সঙ্গে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীর যোগযোগ ছিল।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, জঙ্গি সাইফুল ইসলাম ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট চাকরি খোঁজ করার কথা বলে খুলনার নিজ বাড়ি থেকে ঢাকায় আসেন। সাইফুল মুঠোফোনে জঙ্গি নেতা আকরাম হোসেনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। আকরাম তখন ভারতে অবস্থান করছিলেন। আকরাম বিভিন্ন এজেন্টের বিকাশ নম্বর ব্যবহার করে জঙ্গি সাইফুলকে প্রয়োজনীয় খরচের টাকা দেন। আকরামের নির্দেশে নব্য জেএমবির আরেক সদস্য নাজমুল হাসান মামুনের কাছ থেকে মহাখালী থেকে দুটি বোম নিয়ে আসেন সাইফুল। একই সঙ্গে আকরামের নির্দেশে সাইফুল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের আশপাশ এলাকা রেকি করেন।

হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতীর ফাইল ছবি
হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে আত্মঘাতীর ফাইল ছবি

আকরামের সঙ্গে আত্মঘাতী জঙ্গি সাইফুলের হামলার পরিকল্পনা নিয়ে কী কথোপকথন হয়েছিল, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে অভিযোগপত্রে।
জঙ্গি আকরাম মুঠোফোনে স্লেড উইলসন নামে আইডি খুলে চ্যাট করতেন। আর আত্মঘাতী সাইফুল চ্যাট করতেন মাউন্টেইন, ৯১ নামে। একে অপরকে খুদে বার্তায় আঁখি ছদ্মনাম ব্যবহার করে লিখেছেন।


৭ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তাঁরা খুদে বার্তা আদান–প্রদান করেন।

জঙ্গি সাইফুল-আকরামের খুদে বার্তা
সাইফুল ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট খুলনা থেকে গাড়িতে ওঠার পর আকরামকে খুদে বার্তা দিয়ে জানান, ঢাকায় আসার উদ্দেশ্যে তিনি গাড়িতে রওনা দিয়েছেন। বাড়ি থেকে চাকরির কথা বলে ১০ দিনের জন্য বেরিয়েছেন।


৯ আগস্ট সাইফুল আকরামের কাছে জানতে চান, ‘বাসা বা হোটেল কী রকম টাকার ভেতর দেখব? আর কী রকম জায়গায়?’


জবাবে আকরাম খুদে বার্তায় সাইফুলকে বলেন, ‘ধানমন্ডি ৩২–এর আশপাশে হোটেল দেখেন, যত কমের মাঝে পাওয়া যায়। এখন আমি ১৫০০ টাকা পাঠাচ্ছি। তারপর যা যা লাগবে, তা দিয়ে দিচ্ছি।’


১১ আগস্ট আকরাম সাইফুলের কাছে জানতে চান, যে হোটেলে তিনি উঠেছেন, সেই হোটেলের নাম কী?


জবাবে সাইফুল বলেন, ‘হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনাল।’

তখন আকরাম লেখেন, ‘১৫০-২০০ মরবে। ধানমন্ডি ৩২-এ সকাল থেকে সারা বাংলাদেশ থেকে মিছিল আসবে।’


কোথায় হামলা করার সিদ্ধান্ত হয়, সে ব্যাপারে আকরামের খুদে বার্তায় উল্লেখ রয়েছে, ‘ধানমন্ডি ৩২ বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামের বাইরে।’


সাইফুল লেখেন, ‘জি, মনে থাকবে।’

১৪ আগস্ট বিকেল ৫টা ৩৩ মিনিটে জঙ্গি সাইফুল মহাখালী থেকে বোমা নিয়ে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে ওঠেন।


খুদে বার্তায় আকরাম সাইফুলকে নির্দেশনা দেন, ‘কথা শোনেন, আপনার ওখান (হোটেল) থেকে দুই থেকে তিন মিনিট দূরে ধানমন্ডির ৩২-এ বঙ্গবন্ধু মিউজিয়ামের আশপাশের সব রোড–ঘাট দেখে নেন।’


১৪ আগস্ট রাত ১০টা ৪৭ মিনিটে আকরামকে সাইফুল খুদে বার্তায় লেখেন, ‘আজ দুনিয়ার বুক থেকে আমার শেষ রাত।’

আকরাম হোসেন খান সম্পর্কে অভিযোগপত্রে বলা হয়, আকরাম ২০১৪ সালে এ লেভেল পাস করেন। সে বছরই আকরাম গুলশানের আজাদ মসজিদে ইতেকাফে বসেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে নাইজেরিয়ার নাগরিক ওয়াহেবি, তামিম আহমেদ চৌধুরী, গালিব, তুরাজ, নিবরাসদের (হোলি আর্টিজানে হামলাকারী) সঙ্গে পরিচয় হয়। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের বিভিন্ন অডিও, ভিডিও, ডকুমেন্টারি দেখে আইএসের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নব্য জেএমবিতে যোগ দেন। পরে আমির হয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের নব্য জেএমবিতে যোগদান করান।


আর আত্মঘাতী জঙ্গি সাইফুল খুলনা বিএল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

অভিযোগপত্র ভূক্ত ১৪ আসামি
নব্য জেএমবির আকরাম হোসেন খান, নাজমুল হাসান, আবুল কাশেম, আবদুল্লাহ আইচান কবিরাজ, তারেক মোহাম্মদ আদনান, কামরুল ইসলাম, লুলু সরদার, তাজরীন খান, সাদিয়া হোসনা, আবু তুরাব খান, তানভীর ইয়াসিন করিম, হুমাইয়রা জাকির, আবদুল্লাহ এবং একজন কিশোরকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় সবাই গ্রেপ্তার আছেন।