দোষ পাচ্ছে না পুলিশ, তবু হয়রান ছাত্ররা
>
- নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
- ঢাকার বিভিন্ন থানায় ৬০ মামলা
- গ্রেপ্তার ২২ ছাত্রসহ কয়েক শ আসামি
- লুঙ্গি-হেলমেটধারীরা এখনো অজানা
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের ঘটনায় যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের দোষ এখন খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তের এই পর্যায়ে কাউকে দোষী বা নির্দোষ বলা যাবে না। কিন্তু তদন্ত কবে শেষ হবে, সে খবর তাঁদের কাছে নেই।
তদন্ত শেষ না হওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ ছাত্রসহ অন্য আসামিদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে প্রতি মাসে। মামলা ঝুলে থাকায় তাঁদের শিক্ষাজীবন ও চাকরিজীবন ব্যাহত হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেছেন, শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের প্রতি যতটা সহানুভূতিশীল ছিল, এখন আর তেমন নেই। হাজিরার দিনও পরীক্ষার তারিখ পড়ছে। তাঁদের হয় পরীক্ষা দিয়ে আদালতে যেতে হচ্ছে, নয়তো এসে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। অনেকেই তাঁদের আসামি বলে খ্যাপায়। ‘নেতা হয়ে গেছ’ বলে অনেকে কটাক্ষ করে।
গত বছরের ২৯ জুলাই শহীদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হলে স্কুল-কলেজের ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নামে। ৪ আগস্ট শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে পরদিন প্রথমে রাস্তায় নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, ৬ আগস্ট নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমে আসেন। আর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামার আগেই নিজস্ব ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ হন। তাঁদের ওপর পুলিশ ও লুঙ্গি-হেলমেটধারীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। সপ্তাহব্যাপী চলা ওই আন্দোলনে ঢাকা মহানগর এলাকায় ৬০টি মামলা হয়। বাড্ডা ও ভাটারা থানার পুলিশ ৩২ জনের নাম উল্লেখ করে কয়েক শ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই দুই থানায় দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ ছাত্র।
অভিযোগ ছিল গুরুতর
এজাহারে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল গুরুতর। বাড্ডা থানার মামলায় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করা, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, পুলিশের সরকারি যানবাহনে ভাঙচুর ও বাড্ডা পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগ চেষ্টা করা। ওই মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। প্রাক্তন পাঁচ ছাত্রকে আসামি করা হয় ইন্ধন দেওয়ার জন্য। ভাটারা থানার মামলায় নর্থ সাউথ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ১৩ শিক্ষার্থীসহ অজ্ঞাতনামা অনেককে আসামি করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা সরকারি কাজে বাধা, সরকারি কর্মচারীদের আক্রমণ করে সাধারণ ও গুরুতর জখম, যানবাহনের গতিরোধ করে আটক ও ভাঙচুর করেছেন। ওই ঘটনায় ছয়জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আহত হন গ্রেপ্তারকৃত তিন শিক্ষার্থী ফয়েজ আহম্মদ, মাসাদ মর্তুজা বিন আহাদ ও আজিজুল করিম।
বাড্ডা এলাকায় হামলায় অভিযুক্তরা আটটি তিন ফুট লম্বা বাঁশের লাঠি, ছোট–বড় ছয়টি কাচের টুকরো ও ১০টি ছোট–বড় ভাঙা ইটের টুকরো ব্যবহার করেছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। বাড্ডা ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা কীভাবে হয়েছিল, সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি এজাহারে।
বাড্ডা থানার মামলায় অন্যতম আসামি কাঁকন বিশ্বাস। তাঁর বিরুদ্ধে ‘হামলায় ইন্ধন’ জোগানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। কাঁকন জানান, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন বেশ আগে। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় অফিসে ঢোকেন, ৬টায় বের হন। ২০১৫ সালে স্নাতকোত্তর শ্রেণির ভ্যাট আন্দোলনে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল বলে এই মামলাতেও জড়ানো হয়েছে বলে তাঁর ধারণা।
ভাটারা থানার মামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটিসহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ভাটারা থানার মামলায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র সাবের আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন তিনি একটা ব্যাংকের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এক পুলিশ সদস্য তাঁকে হাতের ইশারায় ডাকেন। কথা বলতে বলতে হাতে হাতকড়া পরান এবং একপর্যায়ে প্রিজন ভ্যানে তুলে দেন। তিনি প্রায়ই তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু মামলার অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন কবে দেবেন, সে নিয়ে পুলিশ কিছু বলে না। সাবের উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যেতে চান। পারবেন কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
এই দুই মামলায় গ্রেপ্তার আরও পাঁচজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, বিনা উসকানিতে তাঁদের ওপর পুলিশ ও লুঙ্গি-হেলমেটধারীরা হামলা চালায়। এই হামলায় আহত কমপক্ষে ৪০ জন অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহত নর্থ সাউথের আশরাফুল ইসলাম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন দীর্ঘ সময়। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা না করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কেন মামলা হলো, সেই প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা।
তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা বলছেন। কিন্তু কবে নাগাদ মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাবেন, সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কিছু করার নেই। তাঁরা ওপরের নির্দেশের অপেক্ষায় আছেন।
বাদী গাড়িচালক, আসামি শিক্ষার্থী
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও লেগুনা এবং বিআরটিসি বাস ভাঙচুরের মামলা হয় স্কুল-কলেজের শত শত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। প্রথমে স্কুল-কলেজশিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও পরে স্কুল-কলেজের দুজন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। মতিঝিল, পল্টন, খিলক্ষেত, ক্যান্টনমেন্ট থানা ও কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলার বাদী মূলত গাড়িচালকেরা।
৫৭ ধারার মামলা ২২টি
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত বছরের আগস্টে মামলা হয় ২২টি। একটিরও তদন্ত শেষ হয়নি। এসব মামলায় শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্য পেশার লোকেরাও আসামি। প্রতি মাসে তাঁদেরও হাজিরা দিতে হচ্ছে। উসকানিমূলক ও অপরাধমূলক লেখা সম্প্রচারের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অনুভূতিতে আঘাত করে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি ও ধ্বংসাত্মক কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য উসকানি ও প্ররোচনার অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে।
একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁরা কোনো ছাড় পাচ্ছেন না। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী লুৎফুন্নাহার লুমা হাজিরা দিয়েছেন ১৬ এপ্রিল। তিনি বলেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় গোলাপি জামা পরে একজন গুজবনির্ভর ভিডিও আপলোড করেছিল। একই রকম জামা পরে থাকায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই মামলায় আরও ১৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। প্রতি মাসে তাঁরা ১৭ জন আদালতে যাওয়া-আসা করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার অপরাধ দমন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের আওয়ামী লীগ অফিসে হত্যা ও ধর্ষণের গুজব ছড়ানো হয়েছিল। তবে সত্যিকার অর্থে কারা গুজব ছড়িয়েছিল, তা জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, গুজব ছড়ানো হয় দেশের বাইরে থেকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার শেখ নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে মামলাগুলো হয়েছিল, সেগুলো তদন্তাধীন আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ছিল যৌক্তিক আন্দোলন। কিন্তু সেই আন্দোলনের ভেতরে অন্য কিছু ঢুকে যাওয়ার কারণে সেটা ব্যর্থ হয়েছে। এতে অংশ নিয়েছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তাদের গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হয়। এখন সরকারের উচিত সহানুভূতির সঙ্গে দেখে মামলাগুলো থেকে দ্রুত অব্যাহতি দেওয়া।