দেশের প্রথম নির্বাচনের ভোটার তাঁরা
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে জীবনের প্রথম ভোট দিয়েছেন—এমন পাঁচজন স্মৃতিচারণা করেছেন। তাঁদের কথায় উঠে এসেছে তখনকার ও এখনকার নির্বাচনী চিত্রের বিস্তর ফারাক।
দেশের প্রথম নির্বাচনে প্রথম ভোট দেন সাদী বক্ত চৌধুরী। তিনি তখন সিলেটের এম সি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্র। সিলেট এম সি কলেজ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদকও ছিলেন। ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংসদের অন্য নেতাদের নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে গ্রামের বাড়িতে যান।
সুনামগঞ্জ-২ আসনে সেবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ (নৌকা)। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন ন্যাপের (মোজাফফর) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (কুঁড়েঘর)। সাদী বক্ত চৌধুরী স্মৃতিচারণা করে বললেন, ‘আমাদের আসনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বেশ প্রভাব ছিল। তা ছাড়া, নৌকার প্রার্থীর ওপর মানুষ কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিল। এ খবর জেনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছুটে গিয়েছিলেন দিরাইয়ে। জনসভায় বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেছিলেন, “...আমি কলাগাছ দাঁড় করালেও মানুষ নৌকায় ভোট দেবে।” বঙ্গবন্ধুকে মানুষ খুব ভালোবাসত। তাই তাঁর কথায় কাজ হয়েছিল। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীই জিতেছিলেন।’
আইনজীবী আশুতোষ মোদক হবিগঞ্জ জেলা সদরের বাসিন্দা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশ স্বাধীনের পর সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ছিলেন পোলিং কর্মকর্তা। ভোট নেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন বানিয়াচং উপজেলার পোকরা ইউনিয়ন কেন্দ্রে। আশুতোষ মোদক বলেন, ‘অনেক ভোটার এসে প্রতীক বলতে না পারলেও আমাদের বলতেন, “আমি বঙ্গবন্ধুকে ভোট দিতাম, তাইলে কীতা করতে অইবো।” আমরা বুঝিয়ে বলতাম। তখন তাঁরা ভোট দিতেন।’ আশুতোষ বলেন, ‘তখন এখনকার মতো একই ব্যালট বাক্সে সব ভোট ঢোকানো হতো না। প্রতিটি প্রতীকের জন্য আলাদা ব্যালট বাক্স রেখে ভোট নেওয়া হতো। তিয়াত্তরের নির্বাচনে প্রথম ব্যালটে সিল মেরে ভোট দেওয়ার নিয়ম চালু হয়।’
বশির আহমদ নগরের আম্বরখানার বাসিন্দা। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের স্মৃতিচারণা করে বশির বলেন, ‘সকাল ৯টার দিকে আমরা ভোটকেন্দ্রে চলে গিয়েছিলাম। কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রথমে অন্যদের ভোট দেওয়া পর্যবেক্ষণ করলাম। পরে ভোট দিলাম।’
সিলেট শহরের বড়বাজার এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী দিলাল আহমদও ১৯৭৩ সালে ভোটার ছিলেন। তিনি বলেন, সিলেট-১ আসনে তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন দেওয়ান ফরিদ গাজী। আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল মালিক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। পীর হবীবুর রহমান ন্যাপের (মোজাফফর) প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে দেওয়ান ফরিদ গাজী জয়লাভ করেন। দিলালের ভাষায়, ‘তখন এখনকার মতো হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ছিল। তখন মূল জনসভা হতো নগরের রেজিস্টারি মাঠে। আম্বরখানা, বন্দরবাজার রংমহল টাওয়ারের সামনে ও লালদীঘিরপার এলাকায়ও ছোট সভা হতো।’
আম্বরখানা বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক গুলজার আহমদ। প্রথম সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন নগরের কিশোরী মোহন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে। তিনি বলেন, ‘ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রচারণায় প্রধানত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে প্রতিশ্রুতি স্থান পায়। আর আওয়ামীবিরোধী জাসদের নেতারা “আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবে”—এমন প্রচারণা চালাতেন।’ তখন ভোটার হওয়ার বয়স কত ছিল—জানতে চাইলে গুলজার আহমদ বলেন, আগে ২১ বছর ছিল। তিয়াত্তরের নির্বাচনেই প্রথম ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর করা হয়। এবারের নির্বাচনের সঙ্গে প্রথম নির্বাচনের তুলনা করতে বললে গুলজার বলেন, ‘ওই সময়ে নির্বাচনে টাকার খেলা ছিল না। এখন টাকা দিয়ে ভোট কেনা হয়। আগে মানুষ রাজনীতি করতেন দেশসেবার জন্য, এখন করেন নিজের সেবার জন্য। প্রশাসনকে ব্যবহার করে ভোট প্রভাবিত করার অভিযোগ প্রথম নির্বাচনে ছিল না। মনোনয়ন–বাণিজ্যও তখন ছিল না। এখন তো মনোনয়ন–বাণিজ্যের অভিযোগ সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে।’