দেশে করোনা সংক্রমণে নিম্নমুখী প্রবণতা
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। দুই সপ্তাহ ধরে কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার নিম্নমুখী। চলতি সপ্তাহ থেকে মৃত্যুও কমতে পারে।
অবশ্য সংক্রমণ নিম্নমুখী হলেও সপ্তাহওয়ারি হিসাবে গত বছর সংক্রমণের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যে পরিমাণ রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছিল, এখনো তার চেয়ে বেশিসংখ্যক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, লকডাউনের প্রভাবে সংক্রমণ কিছুটা কমে এসেছে। অবশ্য এটি নিয়ে ভিন্নমতও আছে। কিন্তু সবাই একমত, এখনো শঙ্কা কমেনি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাদেশ এখনো দূরে। অসতর্ক হলে যেকোনো সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
দেশে গত বছরে ৮ মার্চ করোনা শনাক্ত হয়। আজ ২৪এপ্রিল পর্যন্ত মোট করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৭ লাখ ৪২ হাজার ৪০০। এর মধ্যে মারা গেছে ১০ হাজার ৯৫২ জন। সুস্থ হয়েছেন ৬ লাখ ৫৩ হাজার ১৫১ জন। আজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় ২০ হাজার ৫৭১ নমুনা পরীক্ষায় দুই হাজার ৬৯৭ রোগী শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৮৩ জন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন পাঁচ হাজার ৪৭৭ জন।
শঙ্কার কারণ ব্যাখ্যা করে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ বছর সংক্রমণ খুব দ্রুত ছড়াতে দেখা গেছে, মৃত্যুও হচ্ছে কম সময়ে। করোনাভাইরাসের মতো ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে লকডাউনের একটি প্রভাব থাকে। কিন্তু দীর্ঘ সময় লকডাউন চালানো সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে দোকানপাট খুলে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। ঢাকামুখী পথে মানুষের ভিড় শুরু হয়েছে। শিগগির গণপরিবহনও চালু হতে পারে। সপ্তাহ তিনেক পর ঈদ। ঈদ সামনে রেখে জনসমাগম ও চলাচল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি হয়। আগের বছর ঈদের পর সংক্রমণ বাড়তে দেখা গেছে। কারণ সে সময় স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করা যায়নি। এবারও সব ক্ষেত্রে বিশেষত দোকানপাট, মার্কেট ও গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা না গেলে ঈদের আগে-পরে আবার নাজুক পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কা থাকছে।
ইতিমধ্যে আইইডিসিআরের তথ্যে দেখা গেছে, এবার সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান হলো বাজার ও গণপরিবহন।
বাড়তি ঝুঁকির একটি কারণ হতে পারে প্রতিবেশী ভারত। দেশটিতে সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ। সেখানে করোনার নতুন একটি ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। আকাশ যোগাযোগ বন্ধ হলেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেকগুলো স্থলবন্দরে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে স্থলবন্দরগুলোতে অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কিছুদিন ধরে সংক্রমণে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি ৫ এপ্রিল থেকে যে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তার প্রভাব। এরপর জারি করা সর্বাত্মক লকডাউনের প্রভাব কয়েক দিনের মধ্যে পরিষ্কার হবে। কিন্তু আবার যদি আগের মতো দোকানপাট, মার্কেট, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ভিড় হয়, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই এই অর্জনটা নষ্ট হয়ে যাবে। পরিস্থিতি আবার খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, দরকার অতিরিক্ত সতর্কতা।
গত মার্চ থেকে দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে। সঙ্গে বাড়তে থাকে মৃত্যু। সংক্রমণ ঠেকাতে ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। যদিও তা ছিল ঢিলেঢালা। এরপর ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হয়। সেটি চলবে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত।
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলমান এই মহামারিতে সপ্তাহওয়ারি হিসাবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে সংক্রমণের ৫৭তম সপ্তাহে (৪-১০ এপ্রিল, ২০২১)। ওই সপ্তাহে মোট ৪৮ হাজার ৬৬০ জন রোগী শনাক্ত হন। ওই সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার ছিল ২২ দশমিক ০৪ শতাংশ।
লকডাউনের কারণে সংক্রমণ কমছে কি না, তা বলা মুশকিল। কারণ একটা পর্যায়ে দেশে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিল, তখন লকডাউন ছিল না। সংক্রমণ একাধিকবার ওঠানামা করেছে, এর প্রকৃত কারণ এখনো অজানা।
ওই সপ্তাহের ৫ এপ্রিল থেকে ঢিলেঢালা লকডাউন শুরু হয়। সাধারণত লকডাউনের মতো পদক্ষেপের প্রভাব দেখা যায় দুই সপ্তাহ পর থেকে। তবে ওই লকডাউন ঘোষণার পরের সপ্তাহ থেকেই রোগী কমতে দেখা যায়। চলতি বছরের ১১ থেকে ১৭ এপ্রিল—সংক্রমণের ৫৮তম সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের তুলনায় ২৫ শতাংশ নতুন রোগী কমেছিল। আজ শেষ হওয়া ৫৯তম সপ্তাহে (১৮ থেকে ২৪ এপ্রিল) আগের সপ্তাহের তুলনায় রোগী কমেছে ২৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। এই সপ্তাহে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। তার আগের সপ্তাহে এটি ছিল ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ।
সংক্রমণ কমে এলেও এখনো মৃত্যু বেশি। আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করলে নতুন রোগীও অনেক। আজ শেষ হওয়া সপ্তাহে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৭ হাজার ১৪৮ জন, যা এক সপ্তাহে গত বছরের সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ডের চেয়ে বেশি। গত বছর এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ৭০৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল সংক্রমণের ১৭ তম সপ্তাহে (২৮ জুন থেকে ৪ জুলাই)।
আজ শেষ হওয়া সপ্তাহে মোট ৬৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে মৃত্যু বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। গত বছর এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৩০৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল সংক্রমণের ১৮তম সপ্তাহে (৫-১১ জুলাই)।
আজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে আজ সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৬৯৭ জন। এক মাস পর দৈনিক শনাক্ত তিন হাজারের নিচে নামল। এ নিয়ে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৭ লাখ ৪২ হাজার ৪০০। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট ১০ হাজার ৯৫২ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর সুস্থ হয়েছে মোট ৬ লাখ ৫৩ হাজার ১৫১ জন।
কিছুদিন ধরে সংক্রমণে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি ৫ এপ্রিল থেকে যে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল তার প্রভাব। এরপর জারি করা সর্বাত্মক লকডাউনের প্রভাব আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পরিষ্কার হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউনের কারণে সংক্রমণ কমছে কি না, তা বলা মুশকিল। কারণ একটা পর্যায়ে দেশে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিল, তখন লকডাউন ছিল না। সংক্রমণ একাধিকবার ওঠানামা করেছে, এর প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। তিনি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সবখানে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন বিশেষ করে শতভাগ মাস্ক পরা নিশ্চিত করা, সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা, আইসোলেশন (বিচ্ছিন্ন রাখা) ও কোয়ারেন্টিনের (সঙ্গনিরোধ) ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, দেশকে ছোট ছোট ইউনিটে ভাগ করাই আছে, যেমন ওয়ার্ড— এই ইউনিটভিত্তিক কার্যক্রম চালাতে হবে। ঘরে ঘরে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পরীক্ষা করতে হবে। আক্রান্ত হলে আইসোলেশনে নিতে হবে। তাঁর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। এই কার্যক্রম সারা বছরই চালাতে হবে। অন্যথায় যেকোনো সময় পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।