দেবেশ রায়ের পাঁচ প্রশ্ন

১৯ জানুয়ারি, ১৯৮৭ তিস্তা ব্যারাজের উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে
১৯ জানুয়ারি, ১৯৮৭ তিস্তা ব্যারাজের উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে

পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লেখক দেবেশ রায় তিস্তা নিয়ে ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘তিস্তাকে তিস্তায় ফিরিয়ে দেওয়া হোক’ শীর্ষক নিবন্ধে পাঁচটি প্রশ্ন তুলেছিলেন। দেবেশ রায় লিখেছেন, ‘তিস্তা ব্যারাজ সংক্রান্ত নীচের এই প্রশ্নগুলির কোনো উত্তর কেন্দ্রীয় জল কমিশন, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক, রাজ্য সেচ মন্ত্রক বা গত প্রায় তিরিশ বছরের মধ্যে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার, কোনও রাজ্য সরকার ও কোনো কমিশন দিতে পারেনি।

তিস্তার খাত দিয়ে সারা বছরে মোট কত জল প্রবাহিত হয়? প্রধান ঋতুগুলিতে সেই প্রবাহের পার্থক্য কত দূর ও প্রকারই বা কী? এই স্রোত মাপার ব্যবস্থাটা কী?

তিস্তা ব্যারাজে কী পরিমাণ জল আটকানো হবে ও সেচখাল দিয়ে সেই আটকানো জল কোন ঋতুতে কী পরিমাণে ছাড়া হবে, তার পরিমাণের আন্দাজ কী?

তিস্তা ব্যারাজের জায়গা গজোলডোবা থেকে তিস্তার বাংলাদেশে ঢোকার জায়গা অর্থাৎ, ভারতভুক্ত তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার নদীপথের দুই ধারে জলপাইগুড়ি-ময়নাগুড়ি-লাটাগুড়ি-মেখলিগঞ্জ-হলদিবাড়ি ইত্যাদি পুরনো শহর, নতুন শহর, পুরনো গঞ্জ ও বিস্তীর্ণ কৃষি এলাকা। গজোলডোবার ভাটিতে এই ৪০-৫০ কিলোমিটারই ভারতের তিস্তা। গজোলডোবার ব্যারাজে জল আটকালে এই পুরো ভারতের তিস্তাটাও জলহীন হয়ে পড়বে। আসলে ইতিমধ্যেই তা জলহীন হয়ে পড়ছে। তার অর্থ: তিস্তা ব্যারাজের জল ছাড়ার ওপর বাংলাদেশই কেবল নয়, উত্তরবঙ্গের একটি প্রধান কৃষি-এলাকাও জলহীন হয়ে পড়ছে। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র মহাশয় তিস্তা সম্পর্কে তাঁর অনেকগুলি লেখায় এই কথা বলেছেন। আমরা এই কথা বলছি ১৯৮৩-৮৪ সাল থেকে। এই প্রমাণিত আপত্তি নাকচ করতে কী যুক্তি দেবেন কেন্দ্রীয় জল কমিশন? রাজ্য সরকারই-বা এই প্রশ্ন সরাসরি তুলছেন না কেন?

সিকিমের অন্তর্গত ৬২০০ মিটার উঁচু পর্বতশিখরের জোড়াহ্রদ থেকে তিস্তা বেরোচ্ছে। সেই মুখ থেকে তিস্তামুখঘাটে (বাংলাদেশ) মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র খাতে পড়ছে তিস্তা। মোট দৈর্ঘ্য ৪১০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার। নদী তো পাথর নয়, তাই দৈর্ঘ্যও স্থির নয়। ৫০০ কিলোমিটার ধরাই ভাল। এই ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৬০ বর্গ কিলোমিটার স্থায়ী তুষার-অঞ্চল। ১৭২ কিলোমিটার তিস্তার পর্বতখাত। ৯৭ বা ১০০ কিলোমিটার মতো ভারতে তারও অনেকটা অংশ পাহাড়ের সানুদেশ। ১২৪ কিলোমিটার বাংলাদেশে। এই তথ্যগুলি অনেকটা জানা। কিন্তু যা একেবারে জানা নেই, সিকিমে তিস্তায় কতটা জল বয়। পাশাপাশি ঝোরা, নালি, খোলা থেকে কতটা জল পেতে-পেতে তিস্তা সমতলে নামে? এই হিসেব পাওয়া না গেলে তিস্তার মোট জলের পরিমাণ কে স্থির করবে?

উত্তর সিকিমের লাচুং থেকে দক্ষিণ সিকিমের রংপো পর্যন্ত ২১টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তাবিত হয়েছে ও কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের আপত্তি সত্ত্বেও অন্তত ৬টি থেকে ৮টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। সেভকের কাছে সিকিমের ৬টি (ওই প্রস্তাবিত ২১টির মধ্যে) ও পশ্চিমবঙ্গের ২টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ১৫ মিটারের চাইতে উঁচু বাঁধ তৈরি হচ্ছে। ফলে গজোলডোবার আগেই তিস্তার জল তুলে নেওয়া হচ্ছে। এতে তিস্তার মোট জলের পরিমাণ কত কমছে?