দুহাত নেই, তাই কিনতে পারছেন না সিম কার্ড
২০০৪ সাল। বাহার উদ্দিনের বয়স তখন সাত ছুঁই ছুঁই। একদিন বিকেলে বাড়ির পাশে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বসানো ট্রান্সফরমারে একটি পাখি ঢুকে পড়ে। বাহার পাশেই খেলছিলেন। পাখিটি ট্রান্সফরমারে ঢুকতে দেখে চোখ আটকে যায় তাঁর। কিছুক্ষণ অপেক্ষাও করেন। কিন্তু পাখি বের হয় না। পরে নিজেই খুঁটি বেয়ে ওপরে ওঠেন।
ট্রান্সফরমারের কাছে এসে হাত দিতেই বিকট শব্দে ছিটকে পড়েন নিচে। এরপর হারান তাঁর দুটি হাত।
সেই থেকে বাহারের যুদ্ধ শুরু। তবে হাল ছাড়েন না তিনি। নানা বাধা ডিঙিয়ে তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। এখন তিনি চতুর্থ বর্ষে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করে নেন। এতে প্রতিবন্ধিতা কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। এর মধ্যে স্মার্টফোনও কেনেন। শুরুতে মায়ের নামে কেনা সিম কার্ড ব্যবহার করতেন। কিন্তু নিজের নামে সিম কার্ড কিনতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। এখন আঙুলের ছাপ দিতে না পারায় তিনি কিনতে পারছেন না সিম কার্ড।
বাকিটা বাহারের কণ্ঠেই শোনা যাক। বাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দুটি হাত নেই। আঙুলের ছাপ দিতে না পারায় আমার কাছে সিম কার্ড বিক্রি করছে না কেউ। এ নিয়ে আমি মোবাইল সেবাদাতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাস্টমার কেয়ারে ধরনা দিয়েছি।
এসব প্রতিষ্ঠান বলেছে, আমার মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যের মাধ্যমে সিম কার্ড ক্রয় করা যাবে। কিন্তু আমি নিজের নামে কোনো সিম কার্ড কিনতে পারব না। কারণ, আঙুলের ছাপ ছাড়া সিম কার্ড তারা বিক্রি করবে না।’
দেশে সিম কার্ড ক্রয়-বিক্রয়ের নিয়মনীতি তৈরি করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বিটিআরসি সূত্র জানায়, সিম কেনার ক্ষেত্রে আগে আঙুলের ছাপের দরকার হতো না। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিম নিবন্ধনে আঙুলের ছাপ বা বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু হয়।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে কীভাবে আঙুলের ছাপ ছাড়া সিম দেওয়া যাবে তা জানতে চাইলে বুধবার বিকেলে ২০১৬ সালের একটি নির্দেশনা প্রথম আলোর কাছে পাঠায় বিটিআরসি। ওই বছর ২২ মে জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো গ্রাহকের আঙুলের ছাপে গরমিল দেখা দিলে তাকে নিকটস্থ জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ/নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য পাঠাতে হবে। এ ছাড়া কোনো গ্রাহকের আঙুলের ছাপ অথবা আঙুল না থাকলে, ওই গ্রাহককে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ/নির্বাচন কমিশন থেকে প্রত্যয়ন পত্র গ্রহণ করতে হবে। এরপর অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে ওই প্রত্যয়ন পত্রের বিপরীতে যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের ম্যানেজারের মাধ্যমে প্রত্যয়ন পত্রের সত্যায়িত অনুলিপি অপারেটরের কাছে রক্ষিত থাকতে হবে এবং তথ্যভান্ডারে বিষয়টি উল্লেখ থাকতে হবে।
প্রতিবন্ধী গ্রাহকদের সিম নিবন্ধনের সমস্যাটি তখনই আলোচনায় এসেছিল। যা দেখা যায় বিটিআরসির ২০১৬ সালের নির্দেশনায়। বলা হয়, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কোনো কোনো রিটেইলার এমনকি কাস্টমার কেয়ার সেন্টারের প্রতিনিধি অজ্ঞতার কারণে গ্রাহককে প্রয়োজনীয় তথ্য সহায়তা দিতে পারছে না। ভ্রান্ত তথ্য প্রদান করছেন। এতে গ্রাহকদের মধ্যে, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী গ্রাহকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
বাহার উদ্দিন বলেন, ‘পাসপোর্ট ও জন্মনিবন্ধন নিয়ে যাওয়ার পরও সিম কার্ড কিনতে পারিনি। এ ছাড়া সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য সুরক্ষা আইন তৈরি করেছে। অথচ আমি প্রতিবন্ধী বলে নিজের নামে সিম কার্ড ক্রয় করতে পারছি না।’