দুর্ঘটনাস্থলে ট্রেন চলছে অনেক ধীরে
রেললাইনের দুর্ঘটনাস্থল মেরামত করা হয়েছে আগের দিনই (গত সোমবার)। এরপর রাত থেকেই ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত আন্তনগর ও লোকাল ১২টি ট্রেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচালের বড়ছড়া সেতু দিয়ে আসা–যাওয়া করেছে। তবে দুর্ঘটনাস্থলে ট্রেন চলছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক ধীরগতিতে। সর্বোচ্চ গতি হচ্ছে ৫ কিলোমিটার। পাশাপাশি রেললাইনের আরও সংস্কারকাজ চলছে। ঠিকঠাক করা হচ্ছে কারিগরি বিভিন্ন দিক।
গত রোববার রাত ১১টা ৪০ মিনিটে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকামুখী আন্তনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন বড়ছড়া ব্রিজ অতিক্রমের সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সেতু থেকে নিচে পড়ে যায় ট্রেনের পেছনের একটি কামরা। আরও চারটি কামরা কাত হয়ে পড়ে রেললাইনের একপাশে। এতে চার যাত্রীর প্রাণহানি এবং শতাধিক যাত্রী আহত হন। প্রায় ২২ ঘণ্টা ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে সরাসরি ট্রেন চলাচল করতে পারেনি।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজের কাছে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক শ্রমিক সেখানে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছেন। কেউ রেললাইন সোজা করছেন। কেউ হাতুড়ি পিটিয়ে রেলের নাট-বল্টু টাইট করছেন। কেউ পাথর টেনে এনে রেললাইনের সঙ্গে যুক্ত করছেন। কেউ ঘাস বা আগাছা পরিষ্কার করছেন। রেললাইনের পাশেই একদিকে দুর্ঘটনাকবলিত একটি কামরা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। অপর পাশে উল্টে যাওয়া কামরাগুলো আগের মতোই পড়ে আছে। লাইন সম্পূর্ণ ঠিকটাক হওয়ার পর এই কামরাগুলো তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। কর্মরত শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা গতকাল সকাল থেকেই লাইনে কাজ করছেন। কাঠের স্লিপার স্থাপনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করা হচ্ছে। দুর্ঘটনাস্থলে প্রায় ৫০টি কাঠের স্লিপার স্থাপন করা হয়েছে। তবে যতটা প্রয়োজন ততটা কাঠের স্লিপারই স্থাপন করা হবে। বড়ছড়া ব্রিজের ওপরও তখন কাজ চলছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা জানালেন, কাজ তদারকির জন্য তিনি সিলেট থেকে এসেছেন। গত সোমবার ঠিকমতো সব কাজ করা সম্ভব হয়নি। শুধু লাইন চালুর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। লাইনের ‘প্যাকিং’ করা যায়নি। এখনো স্বাভাবিক গতিতে ট্রেন যেতে পারছে না। ট্রেনের গতি স্বাভাবিক করতে লাইনের প্যাকিং ও অ্যালাইনমেন্ট ঠিক করা হচ্ছে। এদিকে গতকাল মঙ্গলবারও নারী-শিশুসহ অনেক মানুষকে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে ট্রেন দুর্ঘটনার স্থানটি দেখতে ভিড় করছেন।
রেলওয়ের ওয়েম্যান কাজল দাস গতকাল বলেন, ‘আমরা আজকে (মঙ্গলবার) কাঠ (স্লিপার) বদলি করছি। হুদি (বাঁকা রেল সোজা করা) করছি। গাচ্ছা (রেলের জোড়া সোজা করা) করছি। রেললাইনে পাথর দেওয়া ও পাথর টানার কাজ করছি।’
বড়ছড়া এলাকায় রেললাইনের একদম পাশ ঘেঁষেই বাড়ি শফিক মিয়ার। তিনি জানালেন, গত সোমবার রাত থেকেই লাইনে ট্রেন চলছে। রাতে ঘুমানোর আগে তিনি দুটি ট্রেন যেতে দেখেছেন। গতকাল মঙ্গলবার সকালেও ট্রেন যেতে দেখেছেন। তবে খুব ধীরগতিতে এখানে ট্রেন চলছে। শফিক মিয়া দুর্ঘটনার রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ঘরে বসে তখন টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ ভাঙচুরের শব্দ পাইছি। ঘর থেকে বাইরে এসে মানুষের কান্না, হল্লা-চিৎকার শুনছি। পরে আবার ঘরে গিয়ে টর্চ নিয়া আসছি। এলাকার মানুষও ছুটে আসছে। এলাকার মানুষ তিনটা বগির সবাইরে উদ্ধার করছে। এরপর প্রশাসনের লোকজন আইছে। একটা বগির লোকজন নিজেরাই নেমে গেছে। এলাকার মানুষ খুব সহযোগিতা করছে।’
এদিকে উপবন দুর্ঘটনার প্রায় ২২ ঘণ্টা পর রেললাইন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। গত সোমবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে প্রথম সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামমুখী উদয়ন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাস্থল অতিক্রম করেছে। এরপর গতকাল মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত আন্তনগরসহ সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ৭টি এবং সিলেটমুখী ৫টিসহ মোট ১২টি ট্রেন বরমচালের দুর্ঘটনাস্থল এলাকা অতিক্রম করেছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ২টা ২৪ মিনিটে স্থানটি অতিক্রম করে সিলেটের দিকে গেছে সুরমা মেইল।
বরমচাল রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বরমচালে আন্তনগর ট্রেন থামে না। কিন্তু দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনাস্থল অতিক্রম করার আগে এখন ট্রেন থামে। তারপর সর্বোচ্চ পাঁচ কিলোমিটার গতিতে এই স্থানটি অতিক্রম করছে। এই স্থানটি অতিক্রমের স্বাভাবিক গতি হচ্ছে ৭০ কিলোমিটার। আপাতত এভাবেই ট্রেন চলছে। নিয়মিত প্রায় সব ট্রেনই চলছে এখন।’