নির্বাচন কমিশন
দুবার ভোটার হয়েছেন ৫ লাখের বেশি মানুষ
দ্বৈত ভোটার হওয়ায় গত জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৫৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইসি। বাকিদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আজ।
দেশের নিবন্ধিত সব ভোটারের আঙুলের ছাপ ও ব্যক্তিগত তথ্য নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে (তথ্যভান্ডারে) সংরক্ষিত আছে। কেউ দ্বিতীয়বার ভোটার হতে চাইলে তা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ার কথা। কিন্তু অনেকেই একাধিকবার ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হচ্ছেন।
২০০৮ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ লাখ ২৯ হাজার ৮০৬ জন দ্বৈত ভোটার চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অর্থাৎ এসব ব্যক্তি দুবার করে ভোটার হয়েছেন, তাঁদের দুটি করে জাতীয় পরিচয়পত্র। ইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এই বিশালসংখ্যক দ্বৈত ভোটার চিহ্নিত হওয়ায় ভোটার নিবন্ধন ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একাধিক নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এ রকম হতে থাকলে ভোটার তালিকার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে আগের মতো বিতর্ক তৈরি হবে।
নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকাকেও ইসি প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এটি হয়েছে। তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
ভুয়া তথ্য দিয়ে ব্যাংকঋণ নেওয়া, অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ; অনৈতিকভাবে অন্যের পেনশন ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ভোগ করাসহ নানা অবৈধ সুবিধা নিতে অনেকে জালিয়াতির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র করে থাকেন। আর ভোটার হওয়ার মাধ্যমেই এই পরিচপয়পত্র পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা দুটি করে পরিচয়পত্র নিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই পরিচয়পত্র অকার্যকর (লক) করে দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের অনেকে হয়তো না বুঝে দুবার দুই জায়গায় ভোটার হয়েছেন। আবার অনেকে দুই জায়গায় নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ ভিন্ন ভিন্ন দিয়েছেন—তাঁরা অবৈধ সুবিধা নেওয়ার জন্য এমনটি করেছেন। এখন পর্যন্ত এ রকম ১ হাজার ৫৭ জন চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৫৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইসি।
ভোটার তালিকা আইন এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, একাধিকবার ভোটার হওয়া, জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য দেওয়া বা তথ্য গোপন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধে জেল–জরিমানার বিধান আছে। আবার কোনো নিবন্ধন কর্মকর্তা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া, দায়িত্বে অবহেলা করে কোনো কাজ বা ইচ্ছাকৃত ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য দোষী হলে তাঁরও জেল–জরিমানার বিধান রয়েছে।
দ্বৈত ভোটারের বিষয়টি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের সভায় আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, একজন ব্যক্তির ভোটার হতে হলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের বাইরে এখন ১০ আঙুলের ছাপ এবং আইরিশ (চোখের মণির ছাপ) দিতে হয়। শুরুর দিকে দুই হাতের চার আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়েছিল। আঙুলের ছাপ ইতিমধ্যে ইসির সার্ভারে আছে কি না, তা ক্রস ম্যাচ (যাচাই) করা হয়। এ কাজ কেন্দ্রীয় সার্ভারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে থাকে। ইসির সার্ভারে থাকা ছাপের সঙ্গে কোনো ছাপ না মিললে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ পরিচয়পত্র করার অনুমোদন দেয়।
ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের কাজ শেষ করার আগেই ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। জালিয়াতি করে দ্বিতীয়বার জাল পরিচয়পত্র পেতে ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের যোগসাজশেও অনেকে নিজের আঙুলের ছাপ ব্যবহার না করে অন্য কারও ছাপ ব্যবহার করেন। অথবা যে ছয়টি আঙুলের ছাপ আগে নেওয়া হয়নি, শুধু সেগুলো নিয়ে থাকেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় সার্ভারে থাকা আঙুলের ছাপের সঙ্গে এই ছাপ মেলে না।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল বুধবার ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক হুমায়ুন কবীর খোন্দকারের দপ্তরে যান এই প্রতিবেদক। তবে কোভিড–১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় মহাপরিচালক সাক্ষাৎ দেননি। তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তার মাধ্যমে লিখিত প্রশ্ন দেওয়া হলে মহাপরিচালক ওই কর্মকর্তার মাধ্যমে জানান, তিনি এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি নন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৫–৬ সালে এম এ আজিজের নেতৃত্বাধীন কমিশনের আমলে ভোটার তালিকায় এক কোটির বেশি ভুয়া ভোটার ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। সেটি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করা হয়। বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠান এই কাজ খতিয়ে দেখে বলেছে, এই তালিকা প্রায় নির্ভুল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ৫ লাখের বেশি দ্বৈত ভোটার। এটা অবিশ্বাস্য। নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকাকেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এর দায় ইসি এড়াতে পারে না। তাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এটি হয়েছে। তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।