দুজনের নামই কামরুল ইসলাম। তবে একজনের নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ আছে। তাঁদের বাবার নামও একই—মো. আবুল খায়ের। দুজনের একজনের ঠিকানা নোয়াখালীর সুধারাম থানার পশ্চিম রাজারামপুরে, অন্যজন অর্থাৎ মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের ঠিকানা সুধারামের পূর্ব রাজারামপুরে।
এই পূর্ব-পশ্চিম রাজারামপুর ঠিকানার ভুলে দুদকের এক মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে নিরপরাধ মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম পড়েছেন ভোগান্তিতে। এ অবস্থায় প্রতিকার চাইতে গত বছর উচ্চ আদালতে রিট করেন তিনি। এর ধারাবাহিকতায় আদালতে দাখিল করা বক্তব্যে দুদক বলেছে, এজাহারে ও অভিযোগপত্রে ‘অনিচ্ছাকৃত’ অভিযুক্তের ক্ষেত্রে পশ্চিম রাজারামপুরের পরিবর্তে পূর্ব রাজারামপুর উল্লেখ করা হয়।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আগামীকাল ২৮ জানুয়ারি ওই রিটের ওপর আদেশের জন্য দিন রয়েছে।
মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথমে পুলিশ বাড়িতে আসে। পরে থানায় গিয়ে তাঁর বাবা জানতে পারেন এক মামলায় তাঁর নামে সাজা আছে। এরপর বাবা মামলার নম্বর সংগ্রহ করে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, তাঁর ও তাঁর বাবার নামের সঙ্গে আসামি ও তার বাবার নামের অনেকটা মিল আছে। তবে সাজাপ্রাপ্ত আসামির প্রকৃত ঠিকানা পশ্চিম রাজারামপুর। এ অবস্থায় হয়রানি এড়াতে রিট করেন তিনি।
এজাহারে ও অভিযোগপত্রে ‘অনিচ্ছাকৃত’ অভিযুক্তের ক্ষেত্রে পশ্চিম রাজারামপুরের পরিবর্তে পূর্ব রাজারামপুর উল্লেখ করা হয়।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আগামীকাল ২৮ জানুয়ারি ওই রিটের ওপর আদেশের জন্য দিন রয়েছে।
আদালতে রিটের পক্ষে আছেন আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী ও বিজয়া বড়ুয়া। দুদকের পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, মামলার বাদী শহীদুল আলম এজাহারে অনিচ্ছাকৃত ভুলে অভিযুক্তের ক্ষেত্রে পশ্চিম রাজারামপুরের পরিবর্তে পূর্ব রাজারামপুর এবং তদন্ত কর্মকর্তা মো. মাহফুজ ইকবাল অভিযোগপত্রে ভুলবশত অভিযুক্তের ক্ষেত্রে পশ্চিম রাজারামপুরের পরিবর্তে পূর্ব রাজারামপুর উল্লেখ করেন। অনিচ্ছাকৃত ভুল উল্লেখ করে আদালতে দুদকের বক্তব্য দাখিল করা হয়েছে। তবে রিটকারী কামরুলকে এক দিনও কারাভোগ করতে হয়নি।
আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দুদকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার একজন তদন্তকারী কর্মকর্তার এ রকম ভুল কখনোই প্রত্যাশিত নয়। কেননা এ জন্য নির্দোষ ব্যক্তিকে খেসারত দিতে হয়, যা ইতিপূর্বে জাহালামের ক্ষেত্রেও দেখেছি।
নথি থেকে জানা যায়, এসএসসি পাসের ভুয়া নম্বর ও প্রশংসাপত্র তৈরি করে মাইজদী পাবলিক কলেজে একাদশ শ্রেণিতে (১৯৯৮-৯৯ শিক্ষাবর্ষ) ভর্তির অভিযোগে কামরুল ইসলামের (ঠিকানা: পূর্ব রাজারামপুর) নামে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে সুধারাম থানায় মামলা করে। জব্দ করা ভর্তির আবেদনপত্রে কামরুলের জন্মতারিখ ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি ও গ্রাম পশ্চিম রাজারামপুর উল্লেখ রয়েছে। তদন্ত শেষে প্রায় ১০ বছর পর দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর ওই মামলায় অভিযোগপত্র দেন, যেখানে কামরুল ইসলামের গ্রামের ঠিকানা পূর্ব রাজারামপুর উল্লেখ করা হয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এ মামলায় ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল আদালতে পুলিশের (পিঅ্যান্ডএ) এক প্রতিবেদনে এক সাক্ষীর বরাত দিয়ে বলা হয়, আসামি মো. কামরুল ইসলাম, বাবা আবুল খায়ের, গ্রাম পূর্ব রাজারামপুর ঠিকানা সঠিক নয়। প্রকৃত আসামি কামরুল ইসলাম, বাবা আবুল খায়ের, গ্রাম পশ্চিম রাজারামপুর, যিনি দেশের বাইরে আছেন। এই মামলায় নোয়াখালীর বিশেষ জজ আদালত ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর রায় দেন। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কামরুল ইসলামকে (পিতা: আবুল খায়ের, গ্রাম: পূর্ব রাজারামপুর) দোষী সাব্যস্ত করে তিনটি ধারায় ৫ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয় রায়ে। সব কারাদণ্ড একসঙ্গে চলবে বলা হয়।
এরপর ওই মামলায় সাজা পরোয়ানার ভিত্তিতে হয়রানি ও গ্রেপ্তার না করতে গত বছরের অক্টোবরে মোহাম্মদ কামরুল (পূর্ব রাজারামপুর) রিট করেন। এতে যুক্ত এক প্রত্যয়নপত্রে দেখা যায়, তিনি বর্তমানে নোয়াখালী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত। তাঁর সার্ভিস বুক ও এসএসসি পাসের সনদ অনুসারে তিনি ১৯৯০ সালের ১৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ মামলায় উল্লিখিত শিক্ষাবর্ষ (১৯৯৮-৯৯) সময়ে তাঁর বয়স ছিল ৮ বছর। নোয়াখালীর হরিনাথপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে মোহাম্মদ কামরুল এসএসসি পাস করেন বলে ওই প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেন। ওই সাজা পরোয়ানার ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য মোহাম্মদ কামরুলকে কোনো ধরনের হয়রানি ও গ্রেপ্তার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। মোহাম্মদ কামরুলকে শনাক্তকরণ বিষয়ে দুদককে চার সপ্তাহের মধ্যে আদালতে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থায় দক্ষতা, দুর্বলতা ও সংস্কারের অভাবে অবিচার হয়। ফলে বহু নিরীহ ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির শিকার হন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থায় দক্ষতা, দুর্বলতা ও সংস্কারের অভাবে অবিচার হয়। ফলে বহু নিরীহ ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির শিকার হন। অন্যান্য মামলার মতো ইদানীং দুদকের মামলায় এ ধরনের ভুল ধরা পড়ছে। অতএব আরও দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবিচার দূর করতে দুদক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরও সচেষ্ট হবে বলে প্রত্যাশা করি।’