দুই পা নিয়ে বেরিয়ে ঘরে ফিরলেন এক পায়ে ভর দিয়ে
দিনটি ছিল মঙ্গলবার, তারিখ চলতি বছরের ২৭ আগস্ট। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও স্বাভাবিকভাবে রাজধানীর মানিকনগরের নিজের বাড়ি থেকে অফিসে যান। দীর্ঘ ৪৮ দিন পর সেই বাড়িতে ফিরছেন তিনি। তবে এই ফেরা আগের মতো নয়, নিজের বাম পা হারিয়ে, শুধু ডান পায়ে ভর দিয়ে আর অন্যের সহযোগিতায় আজ সোমবার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) ছেড়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) সহকারী পরিচালক কৃষ্ণা রায় চৌধুরী। একটি পা ছাড়া অথবা কৃত্রিম পা নিয়েই বাকি জীবন তাঁকে কাটাতে হবে।
কৃষ্ণা রায় চৌধুরী বলেন, ‘আমার শরীরের একটি অংশ চলে গেছে। এই কষ্ট মেনে নেওয়া যায় না।’
গত ২৭ আগস্ট বেলা আড়াইটার সময় রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন কৃষ্ণা রায় চৌধুরী। ওই সময় বেপরোয়া গতিতে ফার্মগেট থেকে ট্রাস্ট সার্ভিসেস লিমিটেডের বাস চালিয়ে আসছিলেন চালক মোরশেদ। মোরশেদ ওই দিনই প্রথমবারের মতো বাসের স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে রাজপথে নামেন। এর আগে তিনি প্রাইভেট কার চালাতেন। মিডিয়াম ক্যাটাগরির লাইসেন্সধারী মোরশেদ ট্রাস্ট পরিবহনের বাস নিয়ে বাংলামোটরে আসার পরপরই চাপা দেন কৃষ্ণাকে। প্রাণে বেঁচে গেলেও বাম পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন তিনি। সুস্থ হওয়ার জন্য পঙ্গু হাসপাতালের ২১৯ নম্বর কেবিনে থেকেই দেড় মাসের বেশি সময় চিকিৎসা চলছে কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর। এই সময় একইভাবে শুয়ে থাকতে হয়েছে তাঁকে। এপাশ-ওপাশ ঘুরে থাকারও সুযোগ নেই। বাড়ি ফিরেও আরও বেশ কিছু দিন এভাবেই কাটাতে হবে। কাটা পায়ে ক্ষত দূর করতে স্কিন গ্রাফটিং করাতে হয়েছে। এ জন্য ডান পা থেকে চামড়া কেটে নিয়ে অস্ত্রোপচার করে কৃষ্ণা রায়ের বাম পায়ে প্রলেপ (গ্রাফটিং) দিতে হয়েছে। তাই ডান পায়েরও বড় বড় ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি। গত শনিবার পঙ্গু হাসপাতালের দেখা গেছে, ডান পা একটি বালিশের রেখে বিছানায় শুয়ে ছিলেন কৃষ্ণা রায়। আর বাম পায়ের অর্ধেকের বেশি অংশই নেই। কথাবার্তা অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে দুর্ঘটনার কথা মনে হতেই আঁতকে ওঠেন কৃষ্ণা রায়।
কেমন আছেন? হাসপাতালে দীর্ঘ দেড় মাস কেমন কাটল? দুটি প্রশ্ন করতে কৃষ্ণা রায় চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন,‘আমার জীবনে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তবে আমার চেয়ে বেশি কষ্ট করতে হয়েছে আমার আত্মীয়স্বজনের। দীর্ঘ দেড় মাস তাঁদের কারও না কারও আমার জন্য হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। আরেকটা কষ্ট হলো আমার শরীরের একটি অংশ চলে গেছে। এই কষ্ট মেনে নেওয়া যায় না।’
এ কথা বলেই কেঁদে ফেললেন কৃষ্ণা রায়। নিজেকে সামাল দিয়ে তিনি বলেন, ‘পায়ের কাটা অংশে অল্পস্বল্প ব্যথা হয়। এ ব্যথা পুরোপুরি যাবে না। শুনেছি, কৃত্রিম পা বসানো হবে। তবে আপাতত সেটি বাম পায়ে স্থাপন করা হচ্ছে না।’
কৃষ্ণা রায় চৌধুরী বলেন, ‘২০২৩ সালের ২ আগস্ট আমি চাকরি থেকে অবসরে যাব। তাই বাকিটা সময় আমি অফিস করতে চাই। কারণ আমার আয়ের ওপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল।’
হাসপাতালে কথা বলার সময় কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছেলে কৌশিক চৌধুরী। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর প্রথমে তাঁর মায়ের বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ অস্ত্রোপচার করে কেটে ফেলতে হয়। তবে এরপর পায়ের বাকি অংশে ইনফেকশন হয়েছিল। সে জন্য হাঁটুর ওপরে আরও কিছু অংশ ফেলে দিতে হয়। ওই অংশে প্রলেপ দিতে তাঁর মায়ের ডান পা থেকে চামড়া নিয়ে বাম পায়ে স্কিন গ্রাফটিং করেন চিকিৎসকেরা। এটি না করলে কৃত্রিম পা স্থাপন করা যাবে না। তবে হাঁটুর নিচের অংশ অক্ষত থাকলে কিছুটা হলেও তাঁর মা স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারতেন। কৃত্রিম পায়ের খরচও কম পড়ত। এখন সেটি সম্ভব হবে না। কৃত্রিম পা কিনতে খরচও বেশি পড়বে।
কৃষ্ণা রায়ের পরিবারের সদস্যরা জানান, কৃত্রিম পায়ের জন্য মান ভেদে নানা ধরনের দাম রয়েছে। দুই লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। যত বেশি টাকা দেওয়া যাবে, ততটাই ভালো মানের পা পাওয়া যাবে।
বিআইডব্লিউটিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা খোন্দকার মাসুম হাসান প্রথম আলোকে বলেন, পঙ্গু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনা মূল্যে কৃষ্ণা রায় চৌধুরীর কৃত্রিম পা স্থাপনের কথা রয়েছে। এটি দুই মাসের মধ্যে বসানো সম্ভব হবে না। আমরা দেখব সেই পা কেমন কাজ করে। তবে পরবর্তীতে ব্যাংকক বা অন্য কোথাও যোগাযোগ করে আরও ভালো কৃত্রিম পা স্থাপনের ব্যবস্থা করা হবে।
চালক গ্রেপ্তার, হেলপার পলাতক, বাসমালিক জামিনে
কৃষ্ণা রানীকে চাপা দেওয়ার ঘটনায় বাসের মালিক, চালক মোরশেদ এবং চালকের সহকারীকে অভিযুক্ত করে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন তাঁর স্বামী রাধেশ্যাম চৌধুরী। মামলায় বাসচালকের নাম উল্লেখ করা হলেও দুই আসামি বাসমালিক ও চালকের সহকারীর নাম উল্লেখ করা হয়নি। মামলায় বেপরোয়া গতিতে বাস চালিয়ে কৃষ্ণা রানীকে গুরুতর জখমের অভিযোগ করা হয়েছে।
পিবিআই জানায়, ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স না থাকলেও ট্রাস্ট সার্ভিসেসের মিনিবাস চালাতেন চালক মোরশেদ। ঘটনার এক মাসেরও বেশি সময় পর মিরপুরের কাজীপাড়া থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কিন্তু বাসচালকের সহকারী বাচ্চু মিয়া এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। বাচ্চু মিয়াকে ধরতে ময়মনসিংহে তাঁর গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালায় পিবিআই। কিন্তু সেখান থেকে পালিয়ে যান বাচ্চু মিয়া।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাস্ট সার্ভিসেসের বাসের হেলপার বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। চালক মোরশেদ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আদালতে। তবে বাসটির মালিক শফিকুর রহমান মুখ্য মহানগর আদালত (সিএমএম) থেকে জামিন নিয়েছেন।
এদিকে এ ঘটনায় দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি আইনি নোটিশ ৮ সেপ্টেম্বর ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর ডাক মাধ্যমে পাঠান কৃষ্ণা রায়ের স্বামী রাধেশ্যাম চৌধুরী। রাধেশ্যাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার পরদিন ট্রাস্ট সার্ভিসেসের কর্তৃপক্ষ আমাদের দুই লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা সেই টাকা ফিরিয়ে দিয়েছি। যে ধরনের ক্ষতি হয়েছে, সেটি অনেক বেশি। আইনি নোটিশ পাঠানোর পরও ট্রাস্ট সার্ভিসেসের পক্ষ থেকে কোনো যোগাযোগ করেনি।’