দুই নেত্রীর ফোনালাপ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার (২৬ অক্টোবর) ফোন করেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে। তাঁদের ৩৭ মিনিটের ফোনালাপের বড় অংশজুড়ে ছিল পাল্টাপাল্টি আক্রমণ, ছিল উত্তেজনা।
টেলিসংলাপের বিস্তারিত গতকাল বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। এটি ছড়িয়ে পড়েছে ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রচারমাধ্যমেও। বিষয়টির গুরুত্ব এবং পাঠকের আগ্রহ বিবেচনা করে কথোপকথনটি হুবহু প্রকাশ করা হলো। শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর একজন সহকারী (এডিসি) ফোন করেন বিরোধীদলীয় নেতার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের মুঠোফোনে।
তাঁদের প্রাথমিক কথাবার্তার পর শুরু হয় দুই নেত্রীর কথোপকথন।
—আসসালামু আলাইকুম।
জি, এডিসি সাহেব।
—হ্যাঁ, শিমুল দা, আপনি তো ফোন দিলেন না।
না, না। আমরা তো অপেক্ষা করছি আপনার জন্য। ছয়টা থেকে ম্যাডাম বসে রয়েছেন।
— না, না আপনাদের তো কল করার কথা।
না, এ রকম কোনো কথা তো আপনার সাথে আমার হয়নি। আপনি ছয়টায় ফোন দেবেন। ম্যাডামকে আমি আধা ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রেখেছি।
— আমি আপনাকে বলিনি যে আমি ফোন দেব। বিকজ আমরা এক্সপেক্ট করছি আপনারা ফোন দেবেন।
না, আপনি উল্টা কথা বলছেন। এ ধরনের কোনো কথা হয়নি। আমি ম্যাডামকে বলেছি...
—না, আমিও তো বলিনি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোন দেবেন। আমি বলেছি...
আপনি টেলিফোন করে মিলিয়ে দেবেন। এটা আপনার ডিউটি।
—এটা তো আপনারও ডিউটি আছে যে আপনি টেলিফোন করিয়ে মিলিয়ে দেবেন।
ম্যাডাম এখন পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন।
—আমরা অপেক্ষা করছি আপনার কলের জন্য।
ম্যাডাম এখনো বসে আছেন। আপনি দেন, এখনই দেন। ম্যাডামকে দিচ্ছি আমি।
—আছেন ওখানে আপনারা?
জি, জি। ম্যাডাম এখনো আছেন।
—আচ্ছা ওয়েট করেন।
খালেদা জিয়া: হ্যালো, হ্যালো।
শেখ হাসিনা: হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন।
খালেদা জিয়া: আমি আছি, ভালো আছি।
শেখ হাসিনা: আমি ফোন করেছিলাম আপনাকে দুপুর বেলা, পাইনি।
খালেদা: দেখেন, এই কথাটা যে বলছেন, তা সঠিক নয়।
হাসিনা: আমি আপনাকে জানিয়ে দিতে চাই...
খালেদা: আপনাকে প্রথমে আমার কথা শুনতে হবে। আপনি যে বলছেন দুপুরে ফোন করেছিলেন, দুপুরে কোনো ফোন আসেনি। এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। দুপুরে কোনো ফোন আসেনি আমার এখানে।
হাসিনা: আমি রেড ফোনে ফোন দিয়েছিলাম।
খালেদা: রেড ফোন তো দীর্ঘদিন ধরে, বছর ধরে ডেড পড়ে আছে। আপনারা গভর্নমেন্ট চালান, কী খবর রাখেন? গভর্নমেন্ট চালাচ্ছেন, এই খবর রাখেন না যে বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না। আর আপনি যদি ফোন করবেনই, তাহলে গতকালই আপনার লোক এসে ফোন ঠিক করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। দেখে যাওয়া উচিত ছিল যে বিরোধীদলীয় নেতার ফোন ঠিক আছে কি না।
হাসিনা: রেড ফোন সব সময় ঠিক থাকে।
খালেদা: আপনারা লোক পাঠান। এখনই লোক পাঠান। দেখে যান ফোন ঠিক আছে কি না।
হাসিনা: আপনি তো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আপনি জানেন, রেড ফোন সব সময় ভালো থাকে।
খালেদা: ভালো থাকে তো, তবে আমারটা ভালো নেই। আমারটা তো ভালো নেই।
হাসিনা: ভালো আছে, আমি যখন ফোন করেছিলাম, সেটা ভালো ছিল।
খালেদা: না, সেদিনও চেক করেছি। আপনারা যদি সত্যি কথা না বলেন, তাহলে চলবে না।
হাসিনা: আমার সত্যি কথা না বলার তো কিছু নেই। আমি কয়েকবার ফোন দিয়েছি।
খালেদা: হঠাৎ করে কি মৃত ফোন জেগে উঠবে? আপনার টেলিফোন এত পাওয়ারফুল যে ডেড ফোন জেগে উঠবে!
হাসিনা: ঠিক আছে, যেকোনো কারণেই আপনি ফোনটা ধরতে পারেন নাই।
খালেদা: না, ধরতে পারি নাই না। আমি এখানে বসা। আমি এর মধ্যেই ঘুরি। ছোট্ট জায়গা, ছোট্ট জায়গার মধ্যেই আমি ঘুরি। এই ফোন বাজলে আমি না ধরার কোনো কারণ থাকতে পারে না। ডেড ফোন বাজতে পারে না। বুঝেছেন? এটাই হলো সত্যি কথা।
হাসিনা: দেখুন, ডেড ছিল, না ডেড করে রাখা হয়েছে...
খালেদা: ডেড ছিল। বহু কমপ্লেইন আপনাদের কাছে গেছে। কিন্তু আপনারা তো... রেড ফোনে আমার সাথে কথা বলার লোক নেই। কাজেই আমি কার সাথে কথা বলব?
হাসিনা: আমি আগামীকাল দেখব, কেন আপনার ফোন এ রকম ডেড ছিল।
খালেদা: সে তো দেখবেন, ভালো কথা।
হাসিনা: আমি আপনাকে ফোন করলাম। আগামী ২৮ তারিখে ...সন্ধ্যায় গণভবনে আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। আপনি জানেন যে আমি ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি আগামী নির্বাচন সম্পর্কে। আমি আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি।...গণভবনে আসার জন্য।
খালেদা: আপনার যদি সত্যিকারের আন্তরিকতা থাকে আলোচনা করার জন্য, আমার যেতে কোনো আপত্তি নেই। আমি একা যাব না। আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই আরও কেউ থাকবে।
হাসিনা: আপনি যতজন খুশি নিয়ে আসতে পারেন। সমস্যা নেই।
খালেদা: আমি দলবলসুদ্ধ নিয়ে যেতে চাই না। যাঁদের প্রয়োজন মনে করব, তাঁদের নিয়ে যাব। সেটা হতে হবে ২৮ তারিখের পরে। ২৯ তারিখ আমার হরতাল শেষ হওয়ার পরে।
হাসিনা: আমি অনুরোধ করব জাতির স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে হরতাল প্রত্যাহার করে নেন।
খালেদা: না, আমি ২৮ তারিখ যেতে পারব না।
হাসিনা: মানুষ খুন করা, আগুন মারা এসব বন্ধ করুন।
খালেদা: মানুষ খুন করা আপনাদের কাজ। আমাদের সেসব অভ্যাস নাই। আপনারা মানুষ জ্বালান, মানুষ মারেন, লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ মারেন। এসব রেকর্ডেড। আপনার নির্দেশে এবং আপনার মুখ দিয়েই এই শব্দ বেরিয়েছে। কাজেই এসব আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। আমি বলছি, হরতাল চলবে। ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় শেষ হবে, এরপর আলোচনা।
হাসিনা: আমি বলছি, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে দয়া করে এই হরতাল প্রত্যাহার করুন।
খালেদা: না, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থেই আমি এই হরতাল দিয়েছি। যেহেতু আপনারা কোনো আলোচনায় আসতে রাজি নন। আপনার মন্ত্রীরা বলছেন, কোনো আলোচনা হবে না। আপনি নিজে বলেছেন, আমাদের প্রস্তাব রিজেক্ট করে দিয়েছেন। কোনো আলোচনার দরকার নেই, এটা আপনারা বলছেন। এখন আবার আলোচনার কথা বলছেন। সেই আলোচনা হতে পারে, আমাদের কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর।
হাসিনা: আমি আপনাকে অনুরোধ করছি...
খালেদা: না, সেটা সম্ভব না। উদ্যোগটা যদি এক দিন আগে নিতেন, সেটা সম্ভব ছিল।
হাসিনা: এটা এক দিন আগের বিষয় না। আপনি জানেন, আমি বিভিন্ন দলের সঙ্গে বসছি...
খালেদা: আমি জানি, আপনি ব্যস্ত মানুষ। আপনার মতো ব্যস্ত না হলেও আমাদেরও ব্যস্ততা আছে। ইচ্ছা করলে উপায় বের করা যায়। কিন্তু আপনারা সেটা করেননি। কালকে যে আমাদের সমাবেশের পারমিশন দিলেন, এত দেরিতে দিলেন কেন? কত দিন আগে পারমিশন চেয়েছি? মাইক পর্যন্ত লাগাতে দেন না। মানুষ এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনতে পারে না। এটা কোন দেশের গণতন্ত্রের নমুনা দেখছেন আপনি?
হাসিনা: আমি যে সবার সঙ্গে আলোচনা করব, তা কিন্তু বহুদিন আগেই সবাইকে...
খালেদা: আমরা যে সমাবেশ করলাম, সেখানে মাইকের পারমিশন দেওয়া কেন হলো না?
হাসিনা: না, মাইক তো দেওয়া হয়েছে। কয়েকটা মাইক ছিল।
খালেদা: না, আমরা যতদূর ইচ্ছা মাইক দেব। লোক বেশি, শুনবে। লোক আসবে এ জন্য গাড়ি বন্ধ করে দেন, ১৪৪ ধারা জারি করেন। দেশে কি ইমার্জেন্সি চলছে নাকি? দেশে কি যুদ্ধাবস্থা চলছে যে এমন শুরু করে দিলেন আপনারা?
হাসিনা: আমি এ ব্যাপারে এখন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না।
খালেদা: কথা বলতে না চাইলে তো কথাই নেই।
হাসিনা: কথাগুলো সত্য না। আপনারা তো মিটিং করছেন।
খালেদা: আপনারা মিটিং করতে দেবেন মাইক দেবেন না। এমন সময়ে পারমিশন দেবেন, যখন ডায়াসও বানাতে পারব না। আপনারা কি আগে মিটিং করেন নাই?
হাসিনা: সব মনে আছে। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা মনে আছে...