মুর্তজা বশীর ছিলেন একজন বর্ণিল মানুষ। নানা অর্থেই বর্ণিল। তাঁর কথা মনে হলে ভেসে ওঠে এক খ্যাপাটে শিল্পীর মুখ, সব সময় কাজের মধ্য দিয়ে যিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন, পেরেছেনও। নতুন চিন্তানির্ভর কাজের দিকেই বরাবর ঝোঁক ছিল তাঁর। বশীরের চিত্রকর্মগুলোর দিকে ধারাবাহিকভাবে চোখ বোলালে এ কথার সত্য আমাদের কাছে আরও বেশি করে স্পষ্ট হবে। তাঁর চিত্রমালাগুলো—‘রেকেজ’, ‘এপিটাফ’, ‘ওয়েভ’ বা ‘কালেমা তৈয়েবা’ নিয়ে ক্যালিগ্রাফি অথবা তাঁর শেষজীবনের চিত্রকলা ‘উইংস’—এসব সিরিজে বিষয়বস্তু ও চিত্রণকৌশলের জায়গা থেকে বারবার নিজেকে বদলে ফেলেছেন মুর্তজা বশীর। ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। যে কারণে একই বিষয়, ধারা ও করণকৌশলে তিনি কখনোই আটকে থাকেননি।
পঞ্চাশ দশকের এই শিল্পীর সঙ্গে আমার যুক্ততা ছিল পারিবারিক পর্যায়ের। আমার বাবা শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী আর তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর্ট কলেজে পড়ার সূত্রে তাঁদের মধ্যে যে আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠেছিল, তার আবেশে সিক্ত হয়েছিলাম আমরাও—উভয়ের পরিবারের সদস্যরা।
আমার কাছে তিনি যতটা না মুর্তজা বশীর, তার চেয়ে বেশি বশীর চাচা। ২০০৪ সালে গ্যালারি কায়া যখন শুরু করলাম, গেলাম তাঁর কাছে। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে ছবি দেব। তুমি দেবদাসের ছেলে। মানে আমারও ছেলে। ছেলের প্রতি বাবার তো কিছু কর্তব্য থাকে।’ সেই কর্তব্য তিনি আমৃত্যু পালন করেছেন। তাঁর ছবি নিয়ে গ্যালারি কায়ায় একাধিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি আমরা। এই বাবদেও তাঁর সঙ্গে অন্য রকম এক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আমার। ফলে তাঁকে নিয়ে মূল্যায়নধর্মী লেখা তৈরি করা আমার জন্য একটু কঠিন। এ কাজের জন্য যথাযোগ্য মানুষও আমি নই। এখন যেমন লিখতে বসেই বুঝতে পারছি, নানা স্মৃতি এসে ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে। তাই আমার এ লেখায় স্মৃতির আরশির ভেতর দিয়েই বরং মুর্তজা বশীরকে দেখার খানিকটা চেষ্টাচরিত করা যাক।
মুর্তজা বশীর যে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কনিষ্ঠ পুত্র—তাঁকে যখন দেখেছি, তখন এ তথ্য আমার অজ্ঞাত ছিল। মাধ্যমিকে পড়ার সময় থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ততা কিংবা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং এর অব্যবহিত পরে কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামের সেই ঐতিহাসিক সংকলনে তিনি যে লিনোকাটে ছবি এঁকে ইতিহাসকে ফ্রেমে বন্দী করে রেখেছেন—এসব তথ্য ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়া বালকের পক্ষে কেমন করে জানা সম্ভব ছিল সেদিন! ১৯৭২ সালে আমাদের চট্টগ্রামের শহীদ মির্জা লেনের বাসায় তিনি এলেন। আমার বয়স তখন ৮-৯ বছর। এর দু-চার দিন আগে থেকেই মা-বাবার মুখে শুনছিলাম, বাবার এক শিল্পীবন্ধু আমাদের বাসায় আসবেন। তো একদিন বিকেলবেলা দেখলাম, আমাদের বসার ঘরে বাবার পাশে সাংঘাতিক স্মার্ট এক লোক বসে আছেন। অ্যাঙ্কেল বুট জুতা, টাইট বেলবটম প্যান্ট ও অফ হোয়াইট রঙের শার্ট পরা সেই মানুষের বুকের অংশে লাল, নীল, হলুদ—এমন নানা রঙের অজস্র তালিতে ভরা। শার্টের ওই রংগুলো যেন জ্বলছে। তিনি কি পাইপ টানছিলেন? ঠিক মনে নেই। তবে তাঁকে দেখতে সাক্ষাৎ সাহেবের মতোই লাগছিল। সেদিনের সেই সাহেবই ছিলেন মুর্তজা বশীর, আমার বশীর চাচা।
উডকাট, এচিং, লিনো ও কিছু ড্রইং—অনেক আগে করা বশীর চাচার এসব কাজ নিয়ে একটা প্রদর্শনী করেছিলাম ২০০৭ সালে। ওই প্রদর্শনীতে ছিল তাঁর একটি পুরোনো ড্রয়িং, যেটি আর্ট কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ক্লাসওয়ার্ক হিসেবে তিনি এঁকেছিলেন—সিঙ্গেল লাইনে করা একটি হাতের ড্রয়িং। তবে হাতের তর্জনীর জায়গায় লাল কালিতে কাটা দাগ দেওয়া ছিল। আর ছবিতে দেওয়া ছিল কিছু কারেকশনও। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁর ছাত্র মুর্তজা বশীরের ড্রয়িংয়ে এই কারেকশনগুলো দিয়েছিলেন। পাশে লেখা ছিল নম্বর—২৪। মানে এই ড্রইংয়ে ৫০-এর মধ্যে তিনি ২৪ নম্বর পেয়েছিলেন।
তো সেই ছবি আমি যখন প্রদর্শনীতে রাখতে চাইছি, তিনি বললেন, ‘এটা তো আমার খুব প্রথম দিককার ছবি, প্রদর্শনীতে তুমি এটা কেন রাখতে চাও?’ তাঁকে বললাম, ‘আপনি সিঙ্গেল লাইন ড্রয়িংয়ের মাস্টার। কীভাবে কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে দিনে দিনে আপনি তৈরি হয়েছেন, এখানে তার চিহ্ন ধরা আছে।’ বিনা বাক্যে সেদিন আমার কথা মেনে নিয়েছিলেন বশীর চাচা।
স্বভাবে মুর্তজা বশীর ছিলেন খুব মুডি। খেয়ালি মানুষ হলেও তাঁর ভেতরে যুক্তিবোধ ছিল প্রবল। একরোখা ছিলেন বটে, তবে যুক্তি দিয়ে কথা বললে মানতেন। তাঁর চিত্রকর্মের মধ্যেও এই যুক্তি পরম্পরার ছাপ আছে। একবার কথায় কথায় আমাকে বললেন, ‘আমার “এপিটাফ”সিরিজটা দেখেছ গৌতম? অনেকে বলে আমি নাকি বিমূর্ত ধারায় ছবি আঁকি। আসলে আমার ছবি কিন্তু বিমূর্ত না। “এপিটাফ”-এ যে পাথরগুলো এঁকেছি, প্রতিটা পাথর কিন্তু আমি দেখেছি। ভেতরে ভেতরে আইডিয়া তৈরি করেছি। তারপর এঁকেছি।’ নিজের ছবি নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষমতা তাঁর ছিল। যেটা আঁকতেন, তার একধরনের ব্যাখ্যা তিনি তৈরি করাতে পারতেন। যখন যেটাকে ঠিক মনে করতেন, নিমেষেই তার পক্ষে অজস্র যুক্তি খাড়া করতে পারতেন।
কথাটি অবশ্য তাঁর সব সৃষ্টিকর্মের বেলায়ও প্রযোজ্য। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, মুর্তজা বশীর শুধু চিত্রকরই ছিলেন না, ছিলেন বহুমাত্রিক মানুষ। কবিতা-গল্প-উপন্যাস যেমন লিখেছেন, পাশাপাশি মুদ্রা নিয়ে গবেষণাও করেছেন। মুদ্রা ও ডাকটিকিট বিষয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। আর আরও যা বলার কথা তা হলো, ছবি আঁকা থেকে শুরু করে সব সৃজনকর্মেই তাঁর একটা অভিপ্রায় ছিল, নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল। বিষয়টি অবশ্য পঞ্চাশের অধিকাংশ শিল্পীর চিত্রেই দেখা যায়। কী আঁকতে চান, কেন আঁকতে চান, সে বিষয়ে তাঁরা সম্যক জানতেন।
পঞ্চাশের দশকে শিল্পী হিসেবে যাঁদের আবির্ভাব, তাঁদের সবারই জন্ম ত্রিশের দশকে। যেমন মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালে। বশীর চাচার মধ্যে বরাবরই একধরনের অস্থিরতা ছিল। ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেন, পরে ছবি আঁকতে শুরু করলেন, এরপর চলচ্চিত্রে আবির্ভূত হলেন স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে। আদতে সব সময়ই তাঁর ভেতরে থই থই করত তারুণ্য, তারুণ্যের উদ্যোম। তাই অশীতিপর হওয়ার পরও সাদার মধ্যে সাদা রঙে নতুন একটি সিরিজ আঁকার আকাঙ্ক্ষা তাঁর হয়েছিল। বলেছিলেন এমন একধরনের ছবি আঁকবেন, যা কাছ থেকে দেখলে এক রকম মনে হবে, আবার দূরে গেলে মনে হবে আরেক রকম।
মৃত্যু তাঁর সেই ইচ্ছাকে বাস্তব হতে দেয়নি ঠিক, কিন্তু এক জীবনে মুর্তজা বশীর যা করেছেন, অনেকের জন্যই সেটা ঈর্ষণীয়। সত্যিকার অর্থে, মানুষ ও মানবসভ্যতার প্রতি গভীর দায়বোধ ছাড়া বোধ হয় এতটা পারা সম্ভব নয়। তাই বশীর চাচাকে নিয়ে অকিঞ্চিৎকর এ লেখার ইতি টানি এই বলে, মতুর্জা বশীর ছিলেন ঘোরগ্রস্ত এক মানুষ, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এক শিল্পী।
গৌতম চক্রবর্তী চিত্রশিল্পী; গ্যালাির কায়ার পরিচালক