স্বাধীনতার ৫০ বছর
দারিদ্র্যের ‘বেঞ্চমার্ক’ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’
পাকিস্তানি লেখক আকবর এস আহমদ লিখেছিলেন, পাকিস্তান ভাঙার জন্য বাঙালিরাই একসময় বঙ্গবন্ধুকে দুষবে। ২০ বছর পর আরেক পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী পারভেজ হুদোবয় নিজের কপাল চাপড়ে বলেছেন, আজকের বাংলাদেশ এক ভিন্ন দেশ।
আমার এক সতীর্থ সেদিন মনে করিয়ে দিলেন এই অর্ধশতকে বাংলাদেশ কীভাবে অভাবিত রকম বদলে গেছে। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে আমরা প্রথম যখন বিদেশে যাই, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিক্রমে সঙ্গে নিতে পেরেছিলাম মোটে পাঁচ পাউন্ড (ব্রিটিশ মুদ্রা)। প্রত্যেকের পাসপোর্টে সেই অর্থের পরিমাণ লিখে দেওয়া হয়েছিল, যাতে বিমানবন্দরে কোনো ঝামেলা না হয়। প্রমাণ হিসেবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর ও সরকারি সিলমোহর সেঁটে দেওয়া হয়েছিল। আর এখন, মাত্র ৫০ বছর পর, দেশ থেকে বেরোনোর সময় যে কেউ আইনসম্মতভাবেই ১০ হাজার ডলার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে আপনাকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে না।
এটা যে উন্নয়নের একটা সূচক হতে পারে, তা আমার সতীর্থ মনে করলেও আমি তাঁর কথায় একমত নই। অন্য সূচক, সম্ভবত আরও অধিক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হলো বাংলাদেশ সম্বন্ধে বিদেশিদের ধারণা বদলে যাওয়া। সত্তর কেন, আশির দশকেও বাংলাদেশ বলতে বোঝাত কিসিঞ্জারের বলা সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। বাংলাদেশ মানেই ভীষণ গরিব একটি দেশ, দুর্ভিক্ষ আর দুর্যোগ যেন দেশটির অন্য নাম। ১৯৮৯ সালে নিউইয়র্কে এসে প্রথম সপ্তাহেই পত্রিকায় পড়লাম, নিউইয়র্কের হার্লেম, যেখানে প্রধানত দরিদ্র কালো মানুষদের বাস, সেখানে শিশুমৃত্যুর হার অত্যন্ত উঁচু। কতটা উঁচু তা বোঝাতে টানা হয়েছে বাংলাদেশের নাম। অন্য কথায়, দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নের ‘বেঞ্চমার্ক’ হচ্ছে বাংলাদেশ। কোন দেশ কতটা পিছিয়ে, তা মাপতে হলে বাংলাদেশকে একদম তলানির একটি দেশ ভেবে বাকিদের বিচার করতে পারো।
আমি লিখেছিলাম, এই দেশটি দুর্ভাগ্যের প্রাচুর্যে ভরপুর। আমি ভুল লিখেছিলাম, গত তিন দশকের অভাবিত অগ্রগতি থেকে সেটা প্রমাণিত হয়েছে
আজ ৩০-৩২ বছর পর এই দৃশ্যটা একদম বদলে গেছে। এখন উল্টো, বাংলাদেশ বলতে বোঝায় এমন এক দেশ যে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ের এক উদাহরণ। অন্য যেকোনো দেশ, এমনকি আমেরিকা পর্যন্ত বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস-এর নামজাদা কলাম লেখক নিকোলাস ক্রিস্টফ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে পরামর্শ দিয়েছেন, দারিদ্র্য কাটাতে কী কী করা উচিত, তার শিক্ষা বাংলাদেশের কাছ থেকে নিতে। কোভিডের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দাবস্থার শিকার। এখানে দারিদ্র্য বাড়ছে, বাড়ছে অনাহার ও অপুষ্টি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশু। ক্রিস্টফ লিখেছেন, এই সব সমস্যা একসময় বাংলাদেশেরও ছিল। দেখে নাও দেশটি কীভাবে সে সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।
নিক ক্রিস্টফ আরও লিখেছেন, ‘১৯৯১ সালে এক প্রলয়ংকরী ঝড়, যাতে প্রায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, তা সরেজমিনে দেখে আসার পর আমি লিখেছিলাম, এই দেশটি দুর্ভাগ্যের প্রাচুর্যে ভরপুর। আমি ভুল লিখেছিলাম, গত তিন দশকের অভাবিত অগ্রগতি থেকে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে অতিমারির আগে তার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭-৮ শতাংশ, যা চীনের চেয়েও দ্রুততর। দেশটিতে মানুষের আয়ুষ্কাল বেড়ে এখন ৭২ বছরে উন্নীত হয়েছে, যা আমেরিকার অনেক জায়গার চেয়ে বেশি। একসময় যে দেশ ছিল হতাশার অন্য নাম, এখন তা বিশ্বকে শেখাতে পারে কীভাবে সামনে এগোতে হয়।’
‘তেজি ষঁাড়’
নিকোলাস ক্রিস্টফ আবেগপ্রবণ মানুষ, তাঁর কথা বাদ দিই। রক্ষণশীল পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, যাকে কোনোভাবেই ‘সেন্টিমেন্টাল’ বলা যাবে না, সপ্তাহ দু-এক আগে তারা লিখেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ‘তেজি ষাঁড়’। সম্প্রতি জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসির তালিকা থেকে উত্তরণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার ভাষ্যকার মাইক বার্ড সে কথার উল্লেখ করে লিখেছেন, একসময় উন্নয়নের মডেল হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দেওয়া হতো। এখন সে স্থান নিয়েছে বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে বাংলাদেশের প্রস্থানের খবর থেকে বোঝা যায়, দেশটি সামনে আরও অনেক দূর যাবে। অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী, যারা উন্নয়নের ভিন্ন পথ অনুসরণ করছে, এটি তাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
দেশটি (বাংলাদেশ) সামনে আরও অনেক দূর যাবে। অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী, যারা উন্নয়নের ভিন্ন পথ অনুসরণ করছে, এটি তাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা
সতর্কবার্তা হোক বা না হোক, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশসমূহ যে সামান্য হলেও নড়েচড়ে বসেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস বলছে, মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলার পথে রয়েছে বাংলাদেশ। এই খবরে আমাদের এই দুই প্রতিবেশী দেশের কারও কারও যে বায়ু চড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
‘ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ আকর্ষণীয়’
নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের কথা ধরুন। সে দেশের স্বরাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি মন্তব্য করেছিলেন, এই দেশটা এতটা গরিব যে সেখানকার মানুষদের যদি ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, তাহলে সে দেশের অর্ধেক মানুষ ভারতে পাড়ি জমাবে। তাঁর সে কথার জবাব বাংলাদেশের কাউকে দিতে হয়নি, দিয়েছেন ভারতের খ্যাতনামা সাংবাদিক কারান থাপার। হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, এই লোকটি (অর্থাৎ রেড্ডি) বাংলাদেশ কোথা থেকে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তার বিন্দুবিসর্গ জানেন না। তিনি এ কথাও জানেন না যে বাংলাদেশ জীবনের গুণগত মান বোঝায় এমন প্রায় সব সূচকেই ভারতকে পিছে ফেলে দিয়েছে। বস্তুত, থাপারের কথায়, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
কোনো কোনো সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে, থাপার তারও হিসাব দিয়েছেন। মাথাপিছু আয় তো রয়েছেই, আরও রয়েছে নারী-পুরুষ উভয়ের আয়ুষ্কাল, শিশুমৃত্যুর হার, নারীশিক্ষা এবং স্কুলে অধ্যয়নরত ছেলে ও মেয়েদের আনুপাতিক হার। থাপার উপহাস করে লিখেছেন, বাংলাদেশিরা ভারতে ছুটে আসবে কেন? ভারতে আসার চেয়ে বাংলাদেশে ঘুণপোকা হয়ে থাকাও সম্ভবত ভালো। থাপারের লেখাটি পড়ে আমার সাবেক বস শশী থারুর (ভারতীয় লেখক ও রাজনীতিবিদ) সে কথায় সমর্থন জানিয়ে টুইট করে সবাইকে তা পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
পাকিস্তানি পণ্ডিতদের দীর্ঘশ্বাস, আর এখন
বাংলাদেশের ব্যাপারে একসময় পাকিস্তানিরাও ঠাট্টাবিদ্রূপ করত। স্বাধীনতার পরপর অনেক পাকিস্তানি পণ্ডিত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মস্ত ভুল করেছে বাংলাদেশ। তাঁদের একজন হলেন আকবর এস আহমদ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান ভাঙার জন্য বাঙালিরাই একসময় তাঁকে দুষবে। জিন্নাহ, পাকিস্তান অ্যান্ড ইসলামিক আইডেনটিটি গ্রন্থে আকবর দাবি করেছেন, পাকিস্তান হলো মহামূল্যবান এক চিনামাটির পাত্র। আর শেখ মুজিব হলেন সে পাত্রের গায়ে উড়ে এসে বসা এক মাছি।
আকবর এস আহমদ একসময় নড়াইলের এসডিও ছিলেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, তখন স্কুলের পরীক্ষায় ছাত্রদের নকল ঠেকাতে গিয়ে শিক্ষকেরা নাকাল হতেন। নব্বইয়ের দশকেও সেখানে একই দৃশ্য। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী, আইনশৃঙ্খলার কোনো বালাই নেই। দেশটা একদম গোল্লায় গেছে। এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
বাংলাদেশিরা ভারতে ছুটে আসবে কেন? ভারতে আসার চেয়ে বাংলাদেশে ঘুণপোকা হয়ে থাকাও সম্ভবত ভালো
আকবরের সে কথার ২০ বছর পর আরেক পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী পারভেজ হুদোবয় পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় নিজের কপাল চাপড়ে বলেছেন, একসময় বলা হতো দরিদ্র ও দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশ ‘লাইফ সাপোর্ট’-এ রয়েছে, (অর্থাৎ তার অবস্থা মরো মরো)। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ এক ভিন্ন দেশ, তাকে বলা হচ্ছে পরবর্তী ‘এশিয়ান টাইগার’। বাংলাদেশ যে পাকিস্তানকে সবদিক দিয়েই ছাড়িয়ে গেছে, পারভেজ হুদোবয়ের কথায়, তার কারণ এই দুই দেশ তাদের ভিন্ন জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকার হল মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। অন্যদিকে পাকিস্তানের জন্য মানব উন্নয়ন আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার সব মাথাব্যথা কীভাবে ভারতের সঙ্গে পাঞ্জা লড়বে, তা নিয়ে।
ঘাটতি আছে, তবে...
বাংলাদেশকে গত ৫০ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘদিন রাজনৈতিক প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে সে গেছে। চার বছরের মাথায় সে জাতির জনককে হারায়। রাজনৈতিক খুনোখুনি ও দুঃশাসনে গেছে আরও দুই দশক। গত ৩০ বছরে কমবেশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে, গণতন্ত্র শিকড় পোঁতার সুযোগ পেয়েছে। দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে যে লড়াই, প্রকৃতপক্ষে তা এই তিন দশকেই হয়েছে। ফলে স্বাধীনতার ৫০ বছর বললেও উন্নয়নের হিসাবে আমরা পেয়েছি মাত্র ৩০ বছর।
একসময় বলা হতো দরিদ্র ও দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশ ‘লাইফ সাপোর্ট’-এ রয়েছে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ এক ভিন্ন দেশ
আমরা এগিয়েছি, তবে আমাদের খামতিরও অভাব নেই, এ কথা আমাদের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আমাদের অর্জন থেকেই আমরা নিজেদের দুর্বলতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে পারি। তবে সে আলোচনা আজ নয়, অন্যদিন। গৌরবময় স্বাধীনতার পাঁচ দশকের প্রাক্কালে আপাতত আসুন নিজেদের অর্জনটুকু উদ্যাপন করি।
●হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক