নিত্যপণ্যের বাজার
দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সংসদে ক্ষোভ
বিরোধী দলের সাংসদেরা বলেছেন, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ। নিত্যপণ্যের দাম কমাতে বাজারে সরকারের তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ।
বাজারে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে জাতীয় সংসদে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন বিরোধী দলের সদস্যরা। তাঁরা বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। দামের ঊর্ধ্বগতির পেছনে যে সিন্ডিকেট কাজ করছে, একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী হয়েও বাণিজ্যমন্ত্রী তা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ‘বাণিজ্য সংগঠন বিল-২০২২’ পাসের আলোচনায় বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন বিরোধী দলের ১০ জন সাংসদ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির তিনজন, জাতীয় পার্টির ছয়জন ও গণফোরামের একজন সাংসদ।
বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, গ্যাসের অভাবে ঢাকায় হাহাকার চলছে। গ্যাসের দাম, তেলের দাম—সব বাড়ানো হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। কিন্তু সেখানে স্বচ্ছতার অভাব আছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা জনপ্রতিনিধি হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ক্ষমতার বলয়ে থেকে সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারেক রহমান লন্ডন থেকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছেন, বিএনপির কারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে—এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা না বলে সরকারকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংরক্ষিত নারী আসনের বিএনপিদলীয় সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হইচই হলো। ১৫ দিনে এক হাজার কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। রুমিনের দাবি, সিন্ডিকেট হলো সরকার। সরকার আর সিন্ডিকেটের মধ্যে পার্থক্য নেই।
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে সরকারের তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপির আরেক সাংসদ মোশাররফ হোসেন।
সরকার কোথাও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে না। ব্যবসায়ীদের সহায়তা করে। সরকার সিন্ডিকেট এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী, কিন্তু তিনি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বলে উল্লেখ করেন জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংসদ পীর ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, সিন্ডিকেট করে তেলের দাম বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে, কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি মন্ত্রী। প্রায় সময় সিন্ডিকেট বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গত সোমবার বাজার থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে বাণিজ্যমন্ত্রী ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন জানিয়ে জাপার এই সাংসদ বলেন, ‘এখন মাননীয় মন্ত্রী যদি ঘোষণা দিয়ে একটু কাঁচাবাজার, সবজি বাজারসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে যেতেন, মানুষও ওই বাজারে যেতে পারত এবং মন্ত্রীর মতো কম দামে জিনিস কিনতে পারত। কারণ, তিনি যতই ভ্যাট কমিয়ে মূল্য কমানোর চেষ্টা করছেন, প্রকৃতপক্ষে বাজারে পণ্যের দাম অত কমেনি।’
দাম নিয়ে লুকোচুরি খেলা
সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সিন্ডিকেট মূল্যবৃদ্ধি করতে পারে না উল্লেখ করে জাপার মহাসচিব ও সাংসদ মুজিবুল হক বলেন, সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কঠোরভাবে বাজারে নজরদারি করতে হবে। বলা হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বেড়েছে। যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, সেগুলোর দাম বাড়তে পারে। যেগুলো যুদ্ধের আগে আমদানি করা হয়েছে এবং যেগুলো দেশি পণ্য, সেগুলোর কেন দাম বাড়বে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবি জানান তিনি।
জাপার আরেক সাংসদ ফখরুল ইমাম বলেন, হাসপাতালে গিয়ে লক্ষাধিক টাকা বিল এলে, বাজারে গেলে বেশি দাম দেখলে বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা মনে পড়ে।
সংসদে বাণিজ্য সংগঠন বিল ‘সিন্ডিকেটের স্বার্থে’ আনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন জাপার সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ। তাঁর মতে, বিলটির মাধ্যমে সিন্ডিকেটকে উৎসাহী করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বাণিজ্য সংগঠন বিলে বলা হয়েছে, বাণিজ্য সংগঠনকে সরকারের কাছ থেকে সনদ ও নিবন্ধন নিতে হবে। বাণিজ্য সংগঠন ছাড়া কোনো সংগঠন বা কোম্পানি ‘ফেডারেশন’, ‘চেম্বার’, ‘কাউন্সিল’, ‘গ্রুপ’, ‘অ্যালায়েন্স’ শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনো দেশ বা অঞ্চলে ব্যবসা শিল্প বা বাণিজ্য ও সেবা খাতে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য যৌথ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং একাধিক যৌথ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সমন্বয়ে গঠিত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি জোটের বিধান রাখা হয়েছে বিলে। এতে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে এসে বিদেশি ব্যবসায়ীরা একটি যৌথ চেম্বার করতে পারবেন।
ব্যবসায়ীরা জনপ্রতিনিধি হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ক্ষমতার বলয়ে থেকে সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
এই বিল পাসের আলোচনায় জাপার সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সাধারণ মানুষ এখন পুষ্টিমানের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলে যে লেবু ২ টাকা, সেটা ঢাকায় ২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্যমন্ত্রীকে আবার যুদ্ধ করতে হবে।
গণফোরামের সাংসদ মোকাব্বির খান বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী দেশের শীর্ষস্থানীয় সফল ব্যবসায়ী। মন্ত্রী হিসেবে তিনি কতটুকু সফল সেটা বলতে না পারলেও, বাজারে গেলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সেটি ভালোভাবে জানা যাবে। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে যুদ্ধকে সামনে নিয়ে এলে হবে না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মূল্য বাড়িয়ে পকেট কেটে অনেক টাকা নিয়ে গেছে।
বিরোধী সাংসদদের বক্তব্যের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, যুদ্ধের কারণে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, এটা তিনি কখনো বলেননি। সরকার কোথাও ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে না। ব্যবসায়ীদের সহায়তা করে। সরকার সিন্ডিকেট এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, একটি টিসিবির ট্রাক থেকে আড়াই শ মানুষকে পণ্য দেওয়া হয়। ছবি দেখানো হয় পণ্যের জন্য মানুষ দৌড়াচ্ছে। ৩০০ জন লাইনে দাঁড়ালে ৫০ জন পাবেন না। বাকি ২৫০ জন যে পণ্য পেয়েছেন, সেটা দেখানো হয় না।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্ভাগ্য আমার, উকিল যখন পার্লামেন্ট মেম্বার হয়, ডাক্তার যখন হয় তাঁকে কেউ বলে না যে উকিল কেন আসছে? কিন্তু আমি ব্যবসায়ী বলে আমার অপরাধ।’
টিপু মুনশি জানান, তিনি ব্যবসা করছেন ৪০ বছর ধরে, আর রাজনীতি করছেন ৫৬ বছর ধরে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ব্যবসায়ী হওয়া কি তাঁর অপরাধ?
এর আগে বাণিজ্য সংগঠন বিলের আলোচনায় বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জাপার সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ রওশন আরা মান্নান বলেন, সরকার ধরলে দাম কমে। যখন সরকার শিথিলতা দেখায়, তখন আবার দাম বাড়ে। বাজারে একটা পণ্যের দাম কমলে আরেকটার দাম বাড়ে—এটা একটা লুকোচুরি খেলার মতো।