কাদের মির্জার ‘সত্যবচন’
দলে অস্বস্তি, সরকার বিব্রত
সাংসদদের দুর্নীতি, নির্বাচনব্যবস্থায় অনিয়ম নিয়ে কাদের মির্জার বক্তব্য প্রভাব ফেলেছে আ. লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে।
কথা দিয়েই শুরু। এই কথা ‘সত্যবচন’ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। বলছেন শুধু একজন—আবদুল কাদের মির্জা। কখনো ফেসবুক লাইভে, কখনো সংবাদ সম্মেলনে, কখনো-বা জনসভায় তিনি পরিবার, দল ও দেশের নির্বাচনব্যবস্থার অনিয়ম নিয়ে নানা প্রশ্ন, অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর সত্যবচন আঞ্চলিক রাজনীতি ছাপিয়ে অস্বস্তি তৈরি করেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে। সরকারের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তবে দল বা সরকারের কেউ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না।
দেড় মাস আগে কথা বলেই হঠাৎ আলোচনায় আসা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত কোনো মুখ নন। এক দশকের বেশি সময় ধরে নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র পদে থাকলেও তাঁর অন্যতম পরিচয় তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই। যে কারণে তাঁর কথা বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে জাতীয় রাজনীতিতেও ঝড় তুলেছে।
কাদের মির্জার বক্তব্য শুরু থেকেই দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে জানিয়েছি। কিন্তু তিনি বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছেন। তাই সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি।
নোয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী এবং ফেনী-২ আসনের সাংসদ নিজাম হাজারীর অপরাজনীতি নিয়ে প্রথমে কথা বললেও পরে মির্জার সত্যবচনে জনপ্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ঘুষ–বাণিজ্য, টেন্ডার–বাণিজ্য, নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়টিও উঠে আসে। কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতাকে নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। পদপদবির জন্য নিজের ভাইয়ের নৈতিক মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটি আসন ছাড়া বাকি আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদেরা পালানোর জন্য দরজা খুঁজে পাবে না—৩১ ডিসেম্বর দেওয়া তাঁর এই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়। আর ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে কাদের মির্জা বলেন, সরকারি কিছু কর্মকর্তা মনে করেন, আওয়ামী লীগকে তাঁরাই ক্ষমতায় এনেছেন। এ জন্য যা ইচ্ছা, তা-ই করছেন। ওই অনুষ্ঠানেই পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক কীভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, সে প্রশ্ন তোলেন।
মির্জার বক্তব্য নিয়ে দল ও সরকারের অবস্থান কী, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতারও পরিষ্কার ধারণা নেই। বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সাতজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে দুজন মন্ত্রীও রয়েছেন। মির্জার বিষয়ে তাঁরা কেউ নাম উদ্ধৃত হয়ে বক্তব্য দিতে চান না। তাঁদের কেউ বলছেন, মির্জা ‘পাগলের মতো আচরণ’ করছেন। কারও মতে, তিনি নিজেকে জাতীয় নেতা হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছেন। নিজের ভাইয়ের আসনের উত্তরসূরি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছেন। তবে বেশির ভাগ নেতাই মনে করছেন, এই ঘটনায় দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় রাজনীতিতে বিভক্তি বেড়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্পষ্ট কোনো ভূমিকা রাখতে বা দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভায় আজ সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন।
নাম না প্রকাশের শর্তে ওই নেতারা বলেছেন, বিভিন্ন এলাকায় দলে কোন্দল আছে। এর সঙ্গে অনেক কেন্দ্রীয় নেতাও যুক্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে কেউ কাউকে মানছেন না।
দলীয় প্রধানের নজরে এলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর ফলে সাংগঠনিকভাবে দল দুর্বল হচ্ছে। দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকায় বিষয়টি টের পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া সরকার পরিচালনায় আমলানির্ভরতা বেড়েছে। আমলাদের সঙ্গেও কোথাও কোথাও স্বার্থের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছেন দলীয় নেতারা। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জেও তেমনটা ঘটেছে।
উল্লেখ্য, গত শনিবার কাদের মির্জার ডাকে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে হরতালের যে কর্মসূচি পালিত হয়েছে, তাতে অন্যতম দাবি ছিল নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিষয়টি নিয়ে এখনো প্রকাশ্যে কিছু না বলায় নোয়াখালীর পরিস্থিতি এখনো উত্তপ্ত। সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন হত্যার ঘটনায় আজ সোমবার বেলা আড়াইটায় বসুরহাটের রূপালী চত্বরে শোকসভা ও মিলাদ মাহফিল করার কথা জানিয়েছেন কাদের মির্জা। এর আগে একই স্থানে বেলা তিনটায় বিক্ষোভ–সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে দলের আরেকটি পক্ষ। এই পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান। তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের অনুসারী। মিজানুরের কর্মসূচির বিষয়ে নোয়াখালী ও ফেনীর দলীয় দুই সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী ও নিজাম হাজারীর উৎসাহ রয়েছে বলে এলাকায় প্রচার আছে।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে সোমবার (আজ) সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। গতরাত ১১টায় ফোনে প্রথম আলোকে এ কথা জানান নোয়াখালী জেলা প্রশাসক খোরশেদ আলম খান। রাতেই এলাকায় ১৪৪ ধরার জারির বিষয়টি মাইকে প্রচার করা হচ্ছে।
এর আগে শনিবার সন্ধ্যায় দলের সব কার্যক্রম থেকে মির্জাকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে চিঠি পাঠানোর কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ। বিজ্ঞপ্তির দুই ঘণ্টা পর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী ফোন করে সাংবাদিকদের জানান, বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, মির্জাকে বহিষ্কার করার সুপারিশ করাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বহাল আছে।
মির্জার বক্তব্য ও স্থানীয় রাজনীতির বিরোধ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারা প্রকাশ্যে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছেন।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে, জেলা কমিটি বহিষ্কারের সুপারিশ করতে পারে। তবে তা অনুমোদন করার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির। অথবা কেন্দ্রীয় কমিটি চাইলে যে কাউকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার বা অব্যাহতি দিতে পারে। নোয়াখালীর ক্ষেত্রে এর কোনোটাই হয়নি। অবশ্য দলের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মির্জাকে বহিষ্কারের বিষয়টি দলের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় আছে।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল এবং দলের নেতাদের বিরুদ্ধে কাদের মির্জার বক্তব্য শুরু থেকেই নিয়মিতভাবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে জানিয়েছি। কিন্তু তিনি বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছেন। তাই সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি।’
খায়রুল আনম চৌধুরী বলেন, তিন-চার দিন আগে কাদের মির্জাসহ জেলার সার্বিক বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তিনি নেত্রীকে সবকিছু বলেছেন। নেত্রী বিষয়টি দেখবেন বলেছেন। নেত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।
অসন্তুষ্ট হলেও কেউ মুখ খুলছেন না
দলীয় সূত্র জানায়, প্রথমে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করেছিলেন, পৌরসভা নির্বাচনে ভোট বাড়ানোর কৌশলের অংশ হিসেবে কাদের মির্জা দল ও স্থানীয় নেতাদের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। কিন্তু আস্তে আস্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে নানা অভিযোগ তুলতে থাকলে পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। তবে দলের সাধারণ সম্পাদকের নিজ জেলা ও পরিবারের সদস্য এর সঙ্গে যুক্ত থাকায় কেউ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চাইছেন না। কাদের মির্জার বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড দলকে বিব্রত করছে—এমনটি কেন্দ্রীয় নেতারা ব্যক্তিগত ও ছোট পরিসরে দলীয় আলোচনায় বলার চেষ্টা করেছেন। বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে—শুরুতে এমন নিশ্চয়তা দেন ওবায়দুল কাদের। কিন্তু ঘটনা গড়াতে থাকলে তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। ওবায়দুল কাদের তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে বলেছেন, তাঁর ভাই কথা শুনছেন না।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ ঘটনায় স্পষ্ট কোনো ভূমিকা বা দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি বলে মনে করেন অনেক নেতা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে দলীয় কোনো নেতা এভাবে দল, সরকার, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য দেওয়ার সাহস পাননি। কাদের মির্জা দেড় মাস ধরে সেটাই করে যাচ্ছেন বড় কোনো বাধা ছাড়া।
আবার তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের পরিবারকে ‘রাজাকার’ পরিবার বলেও মন্তব্য করেন। সেটাও কেউ সেভাবে আমলে নেননি। যদিও একরাম চৌধুরী এই বক্তব্যের জন্য পরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
কোম্পানীগঞ্জের ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের পাশাপাশি নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বলে মনে করেন দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি বলেন, কাদের মির্জা এখন পর্যন্ত যাঁদের লক্ষ্য বানিয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই তাঁর ভাই ওবায়দুল কাদেরের অনুসারী। এমনকি ওবায়দুল কাদেরের সহধর্মিণী ইশরাতুন্নেসা কাদেরেরও সমালোচনা করেছেন তিনি। এর কোনোটাই স্বাভাবিক নয়।
ওই নেতা আরও বলেন, দলকে বিপদে ফেলার কারণে অতীতে লতিফ সিদ্দিকীর মতো বড় নেতাকে মুহূর্তের মধ্যে বাদ দেওয়া হয়েছে। হাজি সেলিমের ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মির্জা কাদের যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, সত্য হলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর যদি মির্জার ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে, সেটাও দলের ভেবে দেখা উচিত।
তবে নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে কাদের মির্জা যেসব কথা বলেছেন, তা নাগরিক সমাজ বহুদিন ধরেই বলে আসছে বলে জানান সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোট নিয়ে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা যা বলতে পারছিলেন না, তা বলে দিচ্ছেন কাদের মির্জা। এটাকে ‘ওয়েক আপ কল’ হিসেবে নেওয়া উচিত। আর সাংগঠনিক যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, সেটি আওয়ামী লীগ দলীয় ফোরামে বিবেচনা করবে।