‘তোমরা আমার ব্যাটাক আইন্যা দেও’
তোমরা আমার ব্যাটাক আইন্যা দেও। দশ পনের দিন আগেও আমার ব্যাটা ফল নিয়া আমাক দেকপ্যার আইছিল। আমার অন্তরহান ফাইট্যা যায়। আমার উৎপলরে, আমি এ্যাহুন পাগল হয়্যা যামুরে। ঢাকার সাভারের ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারের মৃত্যুতে মা অশীতিপর গীতা রানীর আহাজারি কিছুতেই যেন থামছেই না। বিদ্যালয়ের এক ছাত্রের হাতে ছেলের মৃত্যুর ঘটনা কিছুতেই যেন মানতে পারছেন না উৎপল কুমার সরকারের মা। সান্ত্বনা দিতে আসা প্রতিবেশীরাও ভেঙে পড়ছেন কান্নায়।
উৎপল সরকারের মা বিলাপ করতে করতে বলেন, প্রতি রাইতেই আমার ব্যাটা ফোন কইরছে। আমগোরে খবর লিছে। এহুন শুনি ছেলে নাই...। ওরা আমার ব্যাটাক মাইরা ফালাইলো, তোমরা তহুন কী কইরল্যা?। কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ মা গীতা রানী বাক্রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন।
উৎপল কুমার সরকার উল্লাপাড়া উপজেলার এলংজানী গ্রামের মৃত অজিত সরকারের ছেলে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ১০ বছর ধরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে চাকরি করছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। তাঁকে মারধরের অভিযোগ ওঠা শিক্ষার্থী জিপু হাসানের (১৬) বাড়ি আশুলিয়ায়। সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির দশম শ্রেণির ছাত্র ও আশুলয়ার উজ্জল হোসেনের ছেলে।
মঙ্গলবার বিকেলে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার লাহিড়ী মোহনপুর ইউনিয়নের এলংজানী গ্রামে উৎপল কুমারের বাড়িতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। সাভারের ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক ছাত্র তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত শনিবার দুপুরে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মারধরের শিকার হন তিনি। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়।
উৎপল কুমার সরকার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার লাহিরী মহনপুর ইউনিয়নের এলংজানী গ্রামের মৃত অজিত সরকারের ছেলে। গ্রামের একটি স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করার পর উল্লাপাড়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন উৎপল কুমার সরকার। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতোকত্তর শেষ করেন। ২০১১ সালে আশুলিয়ার চিত্তশাই এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। তাঁর নীতি নৈতিকতার জন্য প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি করা হয় তাকে।
উৎপলের বড় ভাই মামলার বাদী অসীম কুমার সরকার কান্নাজড়িত কন্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ ভাই আর তিন বোনের মধ্যে উৎপল সবার ছোট। আমার বাবা অনেক আগে মারা গেছেন। ছোট ভাই উৎপলকে আমরা খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছিলাম। তিন বছর আগে ভাইকে বিয়ে করিয়েছি। এখন আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। আমরা পাঁচ ভাই এখনও একই সংসারে ছিলাম। আমাদের পরিবার সবকিছু উৎপল দেখাশোনা করত। সেই আশুলিয়ার হাকীম মার্কেটে দিপ্ত টেইলার্স নামে আমাদের একটি দোকান করে দিয়েছে। আমরা দুই ভাই সেখানে কাজ করি।
অসীম কুমার সরকার বলেন, উৎপলকে আমার মা সবচাইতে বেশি ভালোবাসত। যে কারনে মা একেবারে ভেঙে পড়েছেন। মা এই শোক কিছুতেই সইতে পারছেন না। আমার বৃদ্ধ অসুস্থ মাকে আমরা এখন কেমন করে বাঁচাবো? উৎপল বাড়িতে এলেই মাকে নিজ হাতে খাওয়াতো। সবার ছোট ভাই আমার। আমাদের, সবার আগে চলে গেল।
এদিকে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর পরিবারের হুমকির মধ্যে রয়েছেন বলে জানালেন নিহত শিক্ষক উৎপল সরকারের আরেক বড় ভাই অশীত কুমার সরকার। তিনি বলেন, স্থানীয়দের কাছে জেনেছি, উৎপলকে পিটিয়ে হত্যায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা উজ্জ্বল হোসেন হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাজী হজরত আলীর ভাগিনা। উজ্জল এলাকার প্রভাবশালী লোক। গাড়ির ব্যবসা করেন তিনি।
শিক্ষক উৎপলকে স্টাম্প দিয়ে পেটানোর কথা শুনেই ঘটনাস্থলে যান উৎপলের আরেক ভাই অশীত কুমার ও তার ভাগনি। তাদের সামনেই অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবা উজ্জল ও তার স্ত্রী এবং তাদের কয়েকজন আত্মীয় এনাম মেডিকেলে এসে প্রকাশ্যে ভয়ভীতি দেখিয়ে নানা কথা ভলতে থাকে বলে অভিযোগ করেন অশীত।
অশীষ কুমার বলেন, আমরা কী করবো এখন? আমরা বিচার পাব কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ। পুলিশ এখনো আসামি আটক করেনি। ওর বাবা-মা আমাদের হুমকি দিল তাদের বিরুদ্ধেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা নিরুপায়। আমরা অন্য জেলার মানুষ তাদের এলাকায় ব্যাবসা করি। এখন সেখানে ব্যাবসা করতে যাওয়াটা আমাদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার হত্যার বিচার নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলামও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অভিযুক্ত ছাত্রের বাবা উজ্জল হোসেন অঢেল সম্পত্তির মালিক। কয়েক দিন আগে ছেলেকে ৫৬ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনে দিয়েছে বলে জানতে পারি। মূলত বাবার প্রশ্রয়েই ছেলে বখাটে হয়েছে। তাদের তো অঢেল টাকা। আমরা বিচার পাব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে আমরা এই হত্যার বিচার চাই। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা না হলে বড় ধরনের আন্দলনে যাব।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, শিক্ষক উৎপল কুমারকে স্টাম্প দিয়ে আঘাত করার পর পেছনের মাঠে স্টাম্প হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল অভিযুক্ত শিক্ষার্থী। এসময় কয়েকজন তাকে আটক করলেও অভিযুক্তের বাবা উজ্জল সেখানে এসে ছেলেকে ছাড়িয়ে নেয়।
অভিযোগ নিয়ে জানতে উজ্জল হোসেনের বাড়িতে গেলে কাউকেই সেখানে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। আশুলিয়া থানার ওসি কামরুজ্জামানের সঙ্গে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি আসামি আটক করা হলে জানানো হবে বলে ফোন কেটে দেন। পরে কল করলেও আর ধরেননি।
সোমবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সিরাজগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে লাহিড়ী মোহনপুর শ্মশানে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের সৎকার হয়েছে।
নিহত শিক্ষকের পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও কলেজে মেয়েদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। শনিবার দুপুরে খেলা চলাকালে দশম শ্রেণির ওই ছাত্র ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে অতর্কিত শিক্ষক উৎপল সরকারের ওপর হামলা চালায়। প্রথমে ওই ছাত্র শিক্ষকের মাথায় আঘাত করে এবং পরে এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে। এ ছাড়া স্টাম্পের সুচালো অংশ দিয়ে পেটের বিভিন্ন অংশে আঘাত করে। পরে শিক্ষকেরা এগিয়ে গেলে ওই ছাত্র সেখান থেকে সটকে পড়ে। গুরুতর আহত অবস্থায় উৎপল সরকারকে প্রথমে আশুলিয়া নারী ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়া হয়। আঘাত গুরুতর হওয়ায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোমবার ভোরে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান বলেন, উৎপল সরকার শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হওয়ায় তিনি শিক্ষার্থীদের আচরণগত সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে পদক্ষেপ নিতেন। কেন ওই ছাত্র এমন ঘটনা ঘটিয়েছে, সেটি এখনো কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছেন না।
নিহত উৎপলের ভাই অসীম কুমার সরকার বলেন, তাঁর ভাই শিক্ষার্থীদের নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি দেখতেন। দশম শ্রেণির ওই ছাত্র ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সময় তাকে বোঝালেও সে সংশোধন হয়নি। উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে স্টাম্প দিয়ে তাঁর ভাইকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।