১০ বছরে তেলের সর্বোচ্চ দাম
আরেক দফা বেড়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৪০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি সুপারশপ থেকে স্থানীয় বাসিন্দা আফজাল হোসেন গতকাল বৃহস্পতিবার রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের পাঁচ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেল কেনেন ৬৮৫ টাকায়, যা ছয় মাস আগেও ৫১৫ টাকা ছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত কয়েক মাসে যতবার তেল কিনেছি, ততবারই দাম বাড়তি দেখেছি।’
ঠিক তা-ই, বাজারে দফায় দফায় ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। তেল আমদানি ও বাজারজাতকারী শীর্ষস্থানীয় একটি কোম্পানি গত সপ্তাহে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণ করেছে ১৪০ টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে বিপণনকারী।
শুধু বোতলজাত সয়াবিন তেল নয়, খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামও ব্যাপক চড়া। চারজনের একটি পরিবারে মাসে পাঁচ লিটারের মতো তেল লাগে। ফলে একটি পরিবারে ছয় মাস আগের তুলনায় এখন মাসে তেলবাবদ খরচ ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা বেশি। বাজারে এখন চালের দাম চড়া। গত সপ্তাহে পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, মসুর ডাল ও অ্যাংকর ডালের দাম কিছুটা বেড়েছে। সব মিলিয়ে বিপাকে সাধারণ মানুষ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, করোনায় আয় কমে যাওয়া মানুষ খাওয়ার অন্যান্য খরচ কমিয়ে শুধু কয়েকটি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে বাজার ব্যয় সীমিত করে এনেছে। চাল ও ভোজ্যতেল তাদের খাদ্যতালিকার সবচেয়ে জরুরি পণ্যের মধ্যে থাকে। দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে।’
এটাই কি সর্বোচ্চ দর
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এর আগে ভোজ্যতেলের সর্বোচ্চ দাম ছিল ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে। ওই বছর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি মেট্রিক টন ১ হাজার ৪০০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। তখন আমদানি কম হওয়ায় বাজারে তেলের ঘাটতিও তৈরি হয়েছিল।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৩৩ টাকা ৫০ পয়সা। দুটি কোম্পানির দুজন কর্মকর্তা ও একজন পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, তখন (২০১২ সালে) বোতলজাত সয়াবিন তেলের এক লিটারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩৫ টাকা। এখন সর্বোচ্চ দাম ১৪০ টাকায় নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল। একটি কোম্পানির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ভোজ্যতেল খাতে তাঁর ২৫ বছরের চাকরিজীবনে বোতলজাত তেলের এত দাম দেখেননি।
এক বছরে ১৯-২৬% বেড়েছে
করোনাকালে গত মে মাসে শীর্ষস্থানীয় দুই ভোজ্যতেল কোম্পানি মেঘনা ও সিটি গ্রুপ সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা কমিয়ে ১০৫ টাকা নির্ধারণ করে। এই দাম মোটামুটি আগস্ট পর্যন্ত একই ছিল। এরপর থেকে বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড তাদের রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের দাম সর্বশেষ বাড়িয়েছে গত ২৪ জানুয়ারি। ওই দিনের তারিখ দিয়ে ১৪০ টাকা লিটারের তেল বাজারে ছাড়া হয়েছে।
বাজারে ফ্রেশ ও তীর ব্র্যান্ডের এক লিটার সয়াবিন তেলের বোতলের এমআরপি এখন ১৩৫ টাকা এবং পুষ্টি ও বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে তা ১৩০ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতলের ক্ষেত্রে রূপচাঁদার তেলের ৬৮৫, ফ্রেশ, তীর ও পুষ্টির ৬৫৫ এবং বসুন্ধরার ৬৫০ টাকা এমআরপি নির্ধারণ করা হয়েছে। বড় বাজারে ব্যবসায়ীরা এমআরপির চেয়ে দাম কিছুটা কমিয়ে বিক্রি করেন। তবে সুপারশপে বোতলের মোড়কে লেখা মূল্য অনুযায়ী তেল বিক্রি করতে দেখা যায়।
ঢাকার মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের কাঁচাবাজার ও কারওয়ান বাজার খুচরা দোকানে গতকাল ১১২ থেকে ১১৫ টাকা লিটারে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি করতে দেখা যায়। আর পাম তেল বিক্রি হয় প্রতি লিটার ১০২-১০৫ টাকা দরে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ বলছে, গত বছরের এ সময়ের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৯ থেকে ২৬ শতাংশ বেশি।
বৈঠকের পর বৈঠক
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছে, চিঠি চালাচালি করেছে, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করিয়েছে—কিন্তু বাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) গত মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ভোজ্যতেল পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়, গত ৭ জুলাই বিশ্ববাজারে এক টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭৪৩ ডলার, যা গত মাসে সাড়ে ১১ শ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এ দরে সয়াবিন তেল দেশের বাজারে ঢুকলে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য দাঁড়াবে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। তবে এখনো চড়া দামের তেল বাজারে আসতে শুরু করেনি।
ভোজ্যতেল আমদানিকারক ও পরিশোধনকারী সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম অস্বাভাবিক বাড়তি। দাম নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে কর কমানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। তবে সেটা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তেলের করকাঠামো নিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে চিঠি চালাচালি করছে। তবে কর কমছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ভোজ্যতেলের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) এক স্তরের বদলে তিন স্তরে আরোপ শুরু হয়। সব মিলিয়ে যে করকাঠামো, তাতে এক লিটার তেলে প্রায় ২৫ টাকা করবাবদ পায় সরকার। বর্তমান কাঠামোয় বিশ্ববাজারে দাম যত বাড়ে, ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাটের পরিমাণও বাড়ে।
ভোজ্যতেল নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ২৪ জানুয়ারি একটি বৈঠক করে। সে বৈঠকে তেলের বাজারের নানা বিচ্যুতি, মূল্য নির্ধারণ ও কর কাঠামো নিয়ে আলোচনা হয়। ট্যারিফ কমিশন তাদের প্রতিবেদনে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বোতলের দামও কমিয়ে ধরতে সুপারিশ করেছিল।
যদিও বৈঠকের কোনো ফল বাজারে দেখা যায়নি। দাম আরও বেড়েছে। এদিকে ট্যারিফ কমিশন সূত্র জানায়, ভোজ্যতেলের বাজার পর্যবেক্ষণ ও যৌক্তিক দাম নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু করেছে।
বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী সোমবার প্রতিবেদনটি পাওয়া যাবে। এরপর বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
দ্রুত পদক্ষেপের তাগিদ
দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ তেল আমদানি করতে হয়। কোম্পানিগুলো অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করার পর পরিশোধন করে তা বাজারজাত করে।
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ছয়টি মিল ভোজ্যতেল সরবরাহ করে। এখন তিনটি দিতে পারছে না। তাই সরকারের উচিত আগামী রমজান মাস মাথায় রেখে বাজারে তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া। তিনি বলেন, এখন বড় উদ্যোগ নিতে হবে। দেরি করা যাবে না।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, ভোজ্যতেলের দাম যেহেতু বিশ্ববাজারে সর্বোচ্চ, তাই সরকারের বাড়তি পদক্ষেপ দরকার। আর ব্যবসায়ীরা যাতে সুযোগ নিয়ে ইচ্ছামতো দাম বাড়াতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।