তেল, চিনি ও ছোলার ভ্যাট ‘প্রত্যাহার’ নিয়ে বিভ্রান্তি
ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলার ওপর থেকে ‘ভ্যাট প্রত্যাহারে’র যে ঘোষণা গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দিয়েছেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কারণ, ছোলা আমদানিতে কোনো শুল্ক-কর আগে থেকেই ছিল না। আর চিনির ওপর নতুন করে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না বলে জানা গেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে।
ভোজ্যতেলের ওপর থেকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) প্রত্যাহার করলে সুফল পাওয়ার কথা। তবে অর্থমন্ত্রী যেভাবে ভ্যাট ছাড় দেওয়ার কথা বলেছেন, তাতে ব্যয় আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে কোম্পানিগুলো।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য ভ্যাট তুলে নিয়েছি। সারা দেশে টিসিবির মাধ্যমে জনগণকে স্বল্প মূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হবে। এতে এক কোটি পরিবার সাশ্রয়ী মূল্যে এসব পণ্য পাবে। সরকার থেকে যে পরিমাণ সহযোগিতা করা দরকার, সেটা করা হচ্ছে। ভোজ্যতেল, চিনি ও ছোলায় ভ্যাট প্রত্যাহার করা হচ্ছে।’
এদিকে সরকারি বিপণন প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) চার ধরনের পণ্য সরাসরি কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল ও ছোলা কিনবে টিসিবি। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভ্যাট-শুল্ক প্রত্যাহারের পাশাপাশি টিসিবিকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, টিসিবির মাধ্যমে বাজারে সঠিকভাবে পণ্য বিতরণ করা গেলে সিন্ডিকেট দাম বাড়ানোর সুযোগ পাবে না।
ছোলায় শুল্ক-কর আগে থেকেই নেই। চিনিতে কর আর কমছে না। তেলে দুই স্তরের ছাড়ে দাম কমবে না।
ভ্যাট–বিভ্রান্তি
এনবিআরের কাস্টমস ট্যারিফ শিডিউল ঘেঁটে দেখা যায়, আড়াই কেজি পর্যন্ত প্যাকেট অথবা টিনের জারে মোড়কজাত করে আনা ছোলার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর রয়েছে। ফলে মোট করভার দাঁড়ায় ২৫ শতাংশ। অবশ্য ব্যবসায়ীরা খোলা অবস্থায় ছোলা আমদানি করেন। সেখানে কোনো শুল্ক-কর নেই।
ছোলায় ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণার বিষয়ে এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, তিনি তাঁর ব্যবসাজীবনে ছোলার ওপর কখনো শুল্ক-কর দেখেননি। মসুর ডালও করমুক্ত।
অপরিশোধিত চিনির ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ছিল ৩০ শতাংশ। গত অক্টোবরে তা কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। এই শুল্ক ছাড়ের মেয়াদ ২৮ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে যায়। তবে গত সপ্তাহে এনবিআর তা আড়াই মাসের জন্য বাড়িয়েছে। এখন চিনির ওপর টনপ্রতি ৩ হাজার টাকা সুনির্দিষ্ট শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও ৫ শতাংশ অগ্রিম কর রয়েছে। এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, চিনি নয়, ভ্যাট প্রত্যাহার করা হচ্ছে শুধু ভোজ্যতেলের ওপর।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, পবিত্র রমজান মাসে যে চিনি বিক্রি হবে, তা ইতিমধ্যে দেশে আমদানি হয়েছে। দেশে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ৪ লাখ ৮৮ হাজার টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৬০ হাজার টন বেশি।
‘আমরা যেহেতু প্রজ্ঞাপন এখনো পাইনি, তাই জানিনা কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তবে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট তুলে নিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং ব্যয় বাড়বে।’
ভোজ্যতেল
অর্থমন্ত্রী গতকাল জানিয়েছেন, সয়াবিনের উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, শুধু উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট তুলে নিলে তাঁদের ব্যয় আরও বাড়বে। কারণ, আমদানি পর্যায়ে যে ভ্যাট রয়েছে, সেটা দিতে হবে। পরে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে রেয়াত নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
ভোজ্যতেল বিপণনকারী শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি টি কে গ্রুপের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশনস) মো. শফিউল আথহার তাসলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যেহেতু প্রজ্ঞাপন এখনো পাইনি, তাই জানিনা কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে। তবে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট তুলে নিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং ব্যয় বাড়বে।’ তিনি বলেন, এখন তিন পর্যায়ে ভ্যাট দাঁড়ায় লিটারপ্রতি ২৬ থেকে ৩০ টাকা।
এদিকে রোজার আগে তেল আমদানি বেড়েছে। দেশে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার টন, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬০ হাজার টন বেশি। সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবীজও ৩৯ হাজার টন বেশি আমদানি হয়েছে।
এদিকে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দেওয়ার পর গতকালই ভ্যাট কমানোর প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ে। ফলে প্রজ্ঞাপন জারি এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। আগামী রোববার বা সোমবারের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করবে এনবিআর। আর আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে।
ভ্যাট প্রত্যাহারে সয়াবিন তেলের দাম কত কমবে—এমন প্রশ্নের জবাবে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রজ্ঞাপন জারির আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এ ব্যাপারে একটা হিসাব করবে। এরপর বলা যাবে।’
সাধারণ মানুষ চায়, যতটুকু ভ্যাট ছাড় দেওয়া হবে, সে অনুযায়ী দাম যেন কমে। বেসরকারি একটি কলেজের শিক্ষক রফিকুল ইসলামকে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা জানানো হলে গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘খুবই ভালো খবর। আশঙ্কা করছি, ব্যাপারটা না এমন হয় যে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকার ভ্যাট নিল না, কিন্তু তেলের দামও কমল না।’