তিস্তা ব্যারাজ: উপকারের পাশে আপত্তিও আছে
আফতাব উদ্দিনের বাড়ি নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়ায়। ৩০ এপ্রিল তাঁর বাড়ির কাছে তিস্তা ব্যারাজের মূল ক্যানেলের পাশে দাঁড়িয়ে কথা হয়। আফতাব বলেন, তাঁর জমি সাড়ে তিন বিঘা। তিস্তা ব্যারাজ হওয়ার আগে পাট, গম, কাউন, তামাক—এসবের চাষ করতেন। তীব্র না হলেও সংসারে অভাব ছিল। এখন নেই। ব্যারাজ পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। জমির পরিমাণ আগের মতোই আছে। তবে এখন ১২ মাস ফসল ফলাতে পারেন।
তিস্তা ব্যারাজের কারণে আফতাবের মতো কৃষকেরা এখন সচ্ছল। কিন্তু ব্যারাজ পেরিয়ে তিস্তা যে পথ ধরে এগিয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য পরিস্থিতি ঠিক বিপরীত। পানি মেলে না তাঁদের। স্বাভাবিকভাবেই এ কথা উঠেছে, যে অন্যায় ভারত করেছে, তা বাংলাদেশেও হয়েছে। ক্ষীণকণ্ঠের এ প্রতিবাদ কেউ আমলে নিচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া কাগজপত্রে দেখা যায়, লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানিতে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। পানি সরবরাহের ক্যানেল তৈরি শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। আর কৃষক সেচের পানি পেতে শুরু করেন ১৯৯৩ সাল থেকে।
ব্যারাজ দোয়ানিতে হলেও বাইরের সাধারণ মানুষ এলাকাটাকে ডালিয়া বলেই জানে। সকাল-সন্ধ্যা দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ব্যারাজ দেখতে আসে। যেন ছোটখাটো পর্যটনকেন্দ্র। বেশ কিছু অস্থায়ী দোকানও বসে নিয়মিত। অনেকে ব্যারাজের অবকাঠামো ও কারিগরি দিক দেখে যেমন অবাক হন, তেমনি ব্যারাজের দুই পাশে শুকনা তিস্তা দেখেও বিস্মিত হন।
৬১৫ মিটার দীর্ঘ ব্যারাজ উত্তর থেকে আসা পানি আটকে দেয়। ব্যারাজে ৪৪টি গেট আছে। উত্তরে পানি বেশি থাকলে বেশিসংখ্যক গেট খুলে দেওয়া হয়। পানি আসা কমতে থাকলে এক এক করে সব গেট বন্ধ করা হয়। দহগ্রাম থেকে দোয়ানিয়া পর্যন্ত এই ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা ভারত থেকে আসা পানির আঁধার বা রিজার্ভার হিসেবে কাজ করে। এই আটকানো পানি ক্যানেল হেড রেগুলেটরের মাধ্যমে সেচের জন্য নেওয়া হয়।
চারটি জেলার (নীলফামারী, রংপুর, বগুড়া ও দিনাজপুর) ১২টি উপজেলায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে প্রকল্পের খাল। এর মধ্যে আছে প্রধান খাল (৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ), মেজর সেকেন্ডারি খাল (৭৪ কিলোমিটার), শাখা খাল (২১৫ কিলোমিটার), উপশাখা খাল (৩৮৮ কিলোমিটার) এবং নিষ্কাশন খাল (৩৮০ কিলোমিটার)।
ব্যারাজের কাছে ডিমলা উপজেলার ডালিয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অফিস। পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. হাফিজুল হক প্রথম আলোকে ব্যারাজের উদ্দেশ্য সাধন বা উপকারিতার বর্ণনা দিলেন। তিনি বলেন, প্রকল্প এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার নেই বললেই চলে। মানুষ কম মূল্যে পানি পায়। কৃষকের কাছ থেকে এক একর জমির পানি বাবদ ৪৮০ টাকা নেওয়া হয়। প্রকল্পের বাইরে একরপ্রতি পানির ব্যয় প্রায় চার হাজার টাকা। এ ছাড়া পুরো প্রকল্প এলাকা আগের চেয়ে অনেক বেশি সবুজ হয়ে উঠেছে।
খাল দেখভালের জন্য লোক নিয়োগ করা আছে। তাঁরা প্রতিটি খালের মুখের গেট খোলা-বন্ধের কাজ করে সেচের পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা ‘গেটম্যান’। তাঁরা ৭৮ জন। তাঁদেরই একজন মো. আব্দুস সামাদ। তিনি একটি শাখাখালের দায়িত্বে আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা হয় ডালিয়া বাজারে। বললেন, ১৯৯৩ সাল থেকে কাজ করছেন। চাকরি তাঁদের স্থায়ী হয়নি। প্রতিবছর জুন মাসে তাঁদের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরিমাণ নির্দিষ্ট করে জানালেন না।
জালের মতো যেমন প্রকল্পের সেচের ক্যানেল বা খাল আছে, তেমনি আছে প্রাকৃতিক নদী-নালা। রংপুরের তারাগঞ্জে স্টিলের ব্রিজের কাছে যমুনেশ্বরী বয়ে গেছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। ঠিক উত্তর থেকে দক্ষিণে যাবে প্রকল্পের প্রধান খাল। এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, নদী অতিক্রম করেছে কংক্রিটের খাল। এখানে নিচের নদীতে আর ওপরের খালে কোনো পানির প্রবাহ দেখা যায়নি।
তবে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের উদ্দেশ্য সাধন ও লক্ষ্যপূরণ নিয়ে প্রশ্ন আছে। রংপুরের পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের শুরুতে দেওয়া হচ্ছিল এক লাখ ১১ হাজার জমিতে। বর্তমানে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ–সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পের শুরুতে বলা হয়েছিল, সেচ–সুবিধা দেওয়া হবে সাড়ে সাত লাখ হেক্টর জমিতে।
ব্যারাজ নিয়ে আপত্তি আছে অনেকের। রেল, নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কুড়িগ্রাম জেলা শাখার দপ্তর সম্পাদক খন্দকার আরিফ বলেন, ব্যারাজের কারণে বিবর্ণ হয়েছে তিস্তার অববাহিকা। যে পানি কুড়িগ্রাম দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কথা ছিল, সেই পানি নিয়ে যাওয়া হয়েছে নীলফামারীসহ অন্যান্য জেলায়। যে অন্যায় ভারত করেছে, তা বাংলাদেশেও হয়েছে।
তিস্তা আলোচনার কালপঞ্জি
*১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) দ্বিতীয় বৈঠকে প্রথমবারের মতো তিস্তার পানি ব্যবহার করে সেচ প্রকল্পের কথা তোলে দুই দেশ
*১৯৭৮ সালের জেআরসির ১৬তম বৈঠকে পানিপ্রবাহ পরিমাপসহ প্রয়োজনীয় বিষয় ঠিক করতে যৌথ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত
*১৯৮৩ সালে জেআরসির ২৫তম বৈঠকে একটি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য পানি ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত হয়। যেখানে ভারতের জন্য ৩৯ এবং বাংলাদেশের জন্য ৩৬ ভাগ পানি বরাদ্দ করে। বাকি ২৫ ভাগ রেখে দেওয়ার কথা বলা ছিল
*১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে অন্তর্বর্তীকালীন ভাগাভাগির সময় শেষ হয়ে যায়
*১৯৮৭ সালের মে মাসে অন্তর্বর্তীকালীন ভাগাভাগির মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়
*২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির খসড়া করেও শেষ পর্যন্ত তা সই করা যায়নি
*২০১৫ সালের জুনে চুক্তি সইয়ের জন্য আরও কিছুটা সময় চান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
*২০১৭ সালের এপ্রিলে নরেন্দ্র মোদি তাঁর ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে চুক্তি সইয়ের আশ্বাস দিয়েছেন
একনজরে গজলডোবা বাঁধ
লম্বা : ১,০০০ মিটার
উচ্চতা : ৮৭ মিটার
উদ্বোধন : ১৯ জানুয়ারি ১৯৮৭
কৃষি : প্রস্তাবিত জমির মাত্র ১৪ শতাংশ
সেচের আওতায় এসেছে