তিন মাসে চালের মজুদ কমেছে ৫ লাখ টন, সংগ্রহ দেড় লাখ টন
সরকারি গুদামে গত তিন মাসে চালের মজুত প্রায় পাঁচ লাখ টন কমেছে। অন্যদিকে এই সময়ে সরকারের গুদামে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র দেড় লাখ টন ধান–চাল। এত দিন সংগ্রহ ধীরগতিতে এগোলেও দুই সপ্তাহ ধরে তা প্রায় থমকে গেছে। চালকলমালিকেরা সরকারি গুদামে ৩৬ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর এবার তাঁরা নতুন গোঁ ধরেছেন। প্রতি কেজি চালে আরও ৪ টাকা প্রণোদনা না দিলে তাঁরা সরকারি গুদামে আর চাল দিতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, তারা কোনোভাবেই সংগ্রহ মূল্য বাড়াবে না। অর্থনীতিবিদ এবং খাদ্যনীতিবিষয়ক সংস্থাগুলোও মনে করছে, এই সময়ে চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়ালে কৃষক তো লাভবান হবেনই না, উল্টো বাজারে অযৌক্তিকভাবে চালের দাম বেড়ে যাবে। দ্রুত সংগ্রহ বাড়িয়ে ভিন্ন উপায়ে চাল মজুত করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়াব না। চালকলমালিকেরা ৩৬ টাকা কেজি দরে সরকারি গুদামে চাল দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ৩১ আগস্টের মধ্যে চাল দিতে না পারলে বা চুক্তির বরখেলাপ হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
সংগ্রহ মূল্য বাড়াতে চালকলমালিকদের আবদার এবং তা না বাড়াতে সরকারের অনড় অবস্থানের মধ্যে অবশ্য মজুত নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। গত মার্চের শুরুতে সরকারি গুদামে চাল ও গম মিলিয়ে মজুত ছিল ১৭ লাখ ৬২ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ছিল ১৪ লাখ ৩৪ হাজার টন। গত ১৫ জুন পর্যন্ত মোট মজুত কমে ১১ লাখ ৬৩ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। আর চালের মজুত কমে হয়েছে ৮ লাখ ৫৪ হাজার টন।
>কেজিতে চার টাকা প্রণোদনা না দিলে সরকারি গুদামে চাল দিতে নারাজ চালকলমালিকেরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফপ্রি বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আখতার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কোনোভাবেই এই মুহূর্তে চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়ানো ঠিক হবে না। এখন দাম বাড়ালে কৃষক তো লাভবান হবেনই না, অন্যদিকে সরকারও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার বাজারেও চালের দাম বেড়ে যেতে পারে। এই গবেষকের মতে, সরকারের উচিত দরপত্রের মাধ্যমে দ্রুত চাল কিনে গুদামে সংগ্রহ বাড়ানো।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর গত মে মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশে দানাদার খাদ্য পরিস্থিতি শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এবার রেকর্ড পরিমাণ ৩ কোটি ৬১ লাখ টন চাল উৎপাদিত হবে। তবে চালের এই উৎপাদনের পুরোটাই দেশের মানুষের খাবার বা ভোগ হিসেবে দরকার হবে। উল্টো আরও দুই লাখ টন চাল আমদানির দরকার হতে পারে।
এদিকে সরকারি সংগ্রহের ধীরগতির কারণে ৪ জুন খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেশের প্রতিটি জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে জরুরি চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এ বছর তার আগের বছরের তুলনায় চার লাখ টন ধান-চাল অতিরিক্ত সংগ্রহ করা হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যে গতিতে ধান–চাল সংগ্রহ হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। সংগ্রহের গতি বাড়ানোর জন্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের ওই চিঠিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে ধান–চালের দাম বেড়ে গেছে। সরকারি হিসাবেই সংগ্রহ মূল্যের চেয়ে বাজারে বেশি দামে ধান–চাল বিক্রি হচ্ছে। ফলে লোকসান দিয়ে তো চাল দেওয়া যায় না। চালকল মালিক সমিতির পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কেজিতে চার টাকা করে প্রণোদনা চেয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, প্রতি কেজি ধান সরকার ২৬ টাকা কেজি দরে সংগ্রহ করছে, আর চাল ৩৬ টাকায়। কিন্তু প্রতি কেজি ধানের দাম ২৬ টাকা হলে সে অনুযায়ী প্রতি কেজি চালের দাম ৪০ টাকা হওয়ার কথা। ফলে সরকারের উচিত সংগ্রহ মূল্য প্রণোদনা হিসেবে দেওয়া। বর্তমান বাজার ও বৈশ্বিক করোনাপরিস্থিতির কারণে চাল ৩৬ টাকায় দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে আপৎকালীন মজুত সংগ্রহ অভিযান ব্যাহত হতে পারে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর দেশে চালের উৎপাদন এবং ভোগ প্রায় সমান সমান হতে পারে। আর করোনার কারণে একটি সংকটময় অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। চালকলমালিকেরা এ ধরনের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অতি মুনাফা করতে চাইবে।’ প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়ে এ ধরনের পরিস্থিতি সামলানোর প্রস্তুতি নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।