আজ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস
তিন বছরে ধর্ষণ বেড়েছে ১২২ শতাংশ
১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যা করেন তিন পুলিশ সদস্য। দিনটি নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা ও প্রতিবাদের প্রতীক।
ইয়াসমিনের মায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় সন্ধ্যায়। ওই সময় সবে তিনি হাতের কাজ শেষ করে উঠেছেন। মধ্যে বিরতি দিয়ে তিনটি বাড়িতে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর কাজ করেন। ফোনালাপের একপর্যায়ে স্বগোতক্তির মতো বললেন, ‘আচ্ছা, কেন নির্যাতন বন্ধ হয় না! আসলে শুধু সভা করলে কাজ হবে না! যারা অন্যায় করে, তাদের মনে ভয় ঢুকাতে হবে।’ এর মানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির কথা বলছেন কি না, জানতে চাইলে হ্যাঁ–সূচক জবাব দেন ইয়াসমিনের মা ফরিদা বেগম (৫৪)।
দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন এখনো দেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা এবং একই সঙ্গে সম্মিলিত প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে রয়েছে।
পুলিশের সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ইয়াসমিনকে (১৩) স্মরণ করে আজ ২৪ আগস্ট দিনটিকে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৫ সালের এই দিনে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাড়ির উদ্দেশে যাওয়া মেয়েটি ভোররাতে বাস থেকে নামে দিনাজপুর দশমাইল রোডে। বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে তাকে টহল পিকআপে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করেন তিন পুলিশ সদস্য।
আইন প্রয়োগের জায়গাগুলোতে জবাবদিহির শৃঙ্খলা তৈরি করা যায়নি। আইনের কার্যকারিতা দৃশ্যমান হলেই নারী নির্যাতনের সংখ্যা কমবে।তাসলিমা ইয়াসমীন, সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইয়াসমিন হত্যার বিচার চেয়ে দিনাজপুরসহ সারা দেশ ফুঁসে ওঠে। ইয়াসমিনের পরিবার বিচারও পায়। ২০০৪ সালে তিন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
শিক্ষাবিদ, আইনজীবী এবং ভুক্তভোগীরা মনে করেন, নারী নির্যাতন বন্ধের যে প্রত্যাশা ও লক্ষ্য নিয়ে ইয়াসমিনকে স্মরণ করা হয়, সেই লক্ষ্য অর্জন থেকে দেশ এখনো অনেক দূরে। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল না থাকার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বহু মাত্রায় নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। নির্যাতনের তুলনায় অপরাধীর সাজার হওয়ার উদাহরণও কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, আইন একধরনের সুরক্ষা বোধ তৈরি করলেও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তা খুব একটা প্রভাব ফেলছে না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে সাজার হার মাত্র ৩-৪ শতাংশ। আইন প্রয়োগের জায়গাগুলোতে জবাবদিহির শৃঙ্খলা তৈরি করা যায়নি। আইনের কার্যকারিতা দৃশ্যমান হলেই নারী নির্যাতনের
সংখ্যা কমবে।
আজ দিবসটি পালন উপলক্ষে দশমাইল রোডে মানববন্ধন করবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দিনাজপুর জেলা শাখা। এই শাখার সভাপতি কানিজ রহমান বলেন, ইয়াসমিনের ঘটনার মতো প্রতিটি ঘটনায় সম্মিলিত প্রতিবাদ করতে পারলে নারী নির্যাতন রোধ করা যেত।
ফরিদা বেগমের বড় সন্তান ছিল ইয়াসমিন। বেঁচে থাকলে ইয়াসমিনের বয়স হতো ৩৯ বছর। ফরিদা বেগমের এখন দুই ছেলে আছে। পরিবারটি দিনাজপুরের সদর উপজেলার গোলাপবাগ গ্রামে বাস করে। ফরিদা জানান, আজ ইয়াসমিনের জন্য বাসায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করবেন।
তিন বছরে ধর্ষণ বেড়েছে ১২২ শতাংশ
বেসরকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে, গত তিন বছরে নারী নির্যাতনের মধ্যে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ধর্ষণ। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ধর্ষণ বেড়েছে ১২২ শতাংশ। ২০১৮ সালে ৭৩২, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ এবং ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে গত বছরের ১৩ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন আনে সরকার। এরপরও ধর্ষণ কমেনি। বেড়েছে অন্যান্য নির্যাতনও।
সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে ৪ জন, ২০১৯ সালে ৩ জন, ২০২০ সালে ৪ জন এবং চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানায় দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ওই সময় মামলাটির তদন্ত করেন সাটুরিয়া থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কালাম। তিনি এবং ওই থানার বর্তমান ওসি আশরাফুল আলম জানান, পুলিশের দুই সদস্যকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মামলাটি চলছে। তাঁরা জামিনে মুক্ত। তবে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এ বছরের মে মাসে ভারত থেকে দেশে ফেরা এক বাংলাদেশি নারী খুলনার একটি আইসোলেশন কেন্দ্রে কোয়ারেন্টিনে থাকার সময় এক পুলিশ সদস্যের ধর্ষণের শিকার হন। মামলাটি সম্পর্কে খুলনা দক্ষিণ পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সোনালী সেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই তরুণীর ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। এরপর অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। ওই পুলিশ সদস্য খুলনা জেলা কারাগারে আছেন।
বিচারপ্রক্রিয়ায় দুর্বলতা
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি বিচারপ্রক্রিয়ার প্রধান বাধা হচ্ছে, পুলিশ প্রমাণগুলো যথাযথভাবে সংগ্রহ করতে পারে না। এতে আসামি খালাস পেয়ে যান। এ ছাড়া সাক্ষীদের সুরক্ষা না থাকায় মামলার প্রধান সাক্ষীদেরও আনা যায় না অনেক সময়। মামলা করার পরও ১০ শতাংশের বেশি সাজা নিশ্চিত হয় না।
ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল–৩ এর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মাহমুদা আক্তারের মতে, দরিদ্র নারীদের ক্ষেত্রে সাক্ষীকে আদালতে আনা বেশি চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। ওই সাক্ষীরা ভাসমান থাকেন, নির্দিষ্ট ঠিকানা না থাকায় খুঁজে পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে আসামির জামিন হয়ে যায়।