তাঁরাও পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার ভাতা!
মানবতাবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল, রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বা এলাকায় অমুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচিত—এমন প্রায় তিন হাজার জনের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে। এঁরা মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও ভাতা নিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিও করছেন তাঁদের সন্তানেরা। এই তিন হাজারের মধ্যে ২ হাজার ৫৭৫ জনের ভাতা স্থগিত করা হয়েছে এবং বাকিদের সনদ বাতিল করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ‘আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হলেই অমুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বন্ধের নির্দেশ দিই। এরপর তদন্ত করে তাঁদের সনদ বাতিল করি এবং এত দিন তাঁরা যে ভাতা বা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তা ফেরত চাওয়া হয়।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা নন কিন্তু ভাতা বা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, এমন অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে তারা ভাতা স্থগিত করে। এরপর বিস্তারিত তদন্ত সাপেক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন সরকারি অফিস, এলাকাবাসীসহ বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে লিখিত ও মৌখিক নানা অভিযোগ আসছে। বিশেষ করে গেজেটভুক্তির জন্য নতুন করে আবেদন চাওয়ার পর থেকেই এসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এঁদের বেশির ভাগই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত সনদ পেয়েছেন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার এবং রাজাকার হিসেবে গেজেটভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতাসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন—এমন দুজনের সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা থেকে জামুকায় অভিযোগ পাঠানো হয়েছে। এঁরা হচ্ছেন নড়াইলের মুলদাইড় গ্রামের শেখ আবদুল হামিদ ও ঝিকড়া গ্রামের মতিয়ার রহমান। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পাঠানো এক চিঠিতে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, মানবতাবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কী করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, তা বোধগম্য নয়। তবে তদন্ত সংস্থা তাঁদের বিষয়ে এখনো কোনো তদন্ত করেনি। এ বিষয়ে জামুকাকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এই দুজনের বিষয়ে স্থানীয় পর্যায়ে অন্তত ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা, ইউনিট কমান্ডার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে তদন্ত সংস্থার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
নড়াইলের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিরক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এঁদের কেউই মুক্তিযোদ্ধা নন। এটা এলাকার সবাই জানেন। শেখ আবদুল হামিদ নিজেই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে স্বীকারও করেছেন, তিনি রাজাকার ছিলেন। এখন ভয়ে গ্রামে আসেন না। কিন্তু ২০১১ সালে ঢাকা থেকে ঠিকই সনদ সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া মতিয়ার রহমানও মুক্তিযোদ্ধা নন। তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়া সনদ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কী করে দিনের পর দিন এঁরা সুবিধা পাচ্ছেন, সেটা আমাদের জানা নেই। এটা খুব কষ্টের বিষয়, রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।’
নড়াইলের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘শেখ আবদুল হামিদ রাজাকার ছিলেন। অস্ত্র নিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন বাড়িতে লুট করেছেন। তিনি নড়াইল থেকে ভাতার তালিকায় নাম ওঠাতে পারেননি। পরে ঢাকায় গিয়ে কীভাবে সনদ নিয়েছেন, তা আমাদের জানা নেই।’
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান প্রথম আলোকে চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না।’ তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘এরা কী করে ভাতা পেল? বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি।’
অভিযুক্ত শেখ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ঢাকা থেকে ২০১১ সালে সনদ নিয়েছি। নড়াইলের থানা কমান্ডার আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছেন, তাই ঢাকা থেকে নিয়েছি। যাঁদের আমি ঘুষ দিইনি, তাঁরা আমাকে রাজাকার বলছে। আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকরি করেছি। আমার সন্তানরাও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি করছে। আমি মিথ্যা বললে ফাঁসি দেন।’ অন্যদিকে মতিয়ার রহমান নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন।
এদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হয়েও দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে মাগুরার সদর উপজেলার হাবিবুর রহমান মোল্লার পরিবার। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন এ বি সিদ্দিকী ও গোলাম রহমান। তাঁরা অভিযোগ করেন, হাবিবুর রহমান মোল্লা মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পাচ্ছেন, কিন্তু তিনি রাজাকারদের সহযোগী ছিলেন। এ অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এর সত্যতা পায়। মাগুরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, হাবিবুর রহমান মোল্লা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়েন এবং কামান্না ক্যাম্পে বিচারের জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। হাবিবুর রহমানকে পারিবারিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করা হলেও তাঁর পরিবার কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি। এলাকার সবাই তাঁকে অমুক্তিযোদ্ধা বলে জানিয়েছেন।
একই এলাকার খাতের আলীর নামে একজনকে ১৯৮৪ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জামুকা এখন এসে জেনেছে, তিনিও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী থাকায় মুক্তিবাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে তিনি নিহত হন।
জামুকার ৩২তম বৈঠকে হাবিবুর রহমান মোল্লা ও খাতের আলীর নামে প্রকাশিত গেজেট ও সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভাতা।
ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার কালীপদ বিশ্বাসকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন সিকদার। কিন্তু জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, কালীপদ বিশ্বাস পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নিহত হননি। কোনো তালিকায় কালীপদ বিশ্বাসের নাম নেই।