তাঁরা বদলাচ্ছেন নিজেদের, বদলাচ্ছে সমাজও
যাত্রীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়, ছিনতাই, শিশুদের জিম্মি করে অভিভাবকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা বাগিয়ে নেওয়া- এরকম অভিযোগে সমাজে বিরূপ ধারণার শিকার হয়েই মানুষগুলোর বাস। তবে বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ আর নানা সাহসী কর্মকাণ্ড এই ধারণা বদলে দিচ্ছে। অনেকেই নতুন করে ভাবছেন তাঁদের নিয়ে।
আলাউদ্দিন আঁখি। এক যুগের বেশি সময় ধরে ছিলেন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। পরিবার ও সমাজের ধারণা পাল্টে দিয়ে আলোর পথে এগিয়ে চলা হিজড়াদের একজন তিনি। প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। এখন বেতনভাতা যাই পাই, যে সম্মান পাই তার মূল্য কোটি টাকার বেশি। আগে হিজড়াগিরি করে যে টাকা আয় করতাম তা আমার পরিবার গ্রহণ করত না। এখন আমি চাকরি করি। পরিবারে এখন টাকা দিলে আগের মতো আর আপত্তি করে না।’
আলাউদ্দিনসহ পাঁচজন হিজড়া ও লিঙ্গ রূপান্তরিত নারী সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে গত তিন বছর ধরে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শুধু আলাউদ্দিন নন, গাজীপুরের এসিআই মটরস লিমিটেডসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন হিজড়া সদস্যরা।
সরকার ২০১৩ সালে নারী, পুরুষের পাশাপাশি হিজড়াদের আলাদাভাবে স্বীকৃতি দেয়। সরকারের ২০১৩ সালের হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা বলছে, হিজড়া শব্দের ইংরেজি পরিভাষা ট্রান্সজেন্ডার। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাদের দৈহিক বা জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সমাজে তাঁরা হিজড়া হিসেবে পরিচিত। সমাজে যিনি হিজড়া হিসেবে পরিচিত এবং যিনি নিজের এ পরিচয় দিতে ইতস্তত বোধ করেন না তাঁকেই হিজড়া বোঝাবে।
সরকারি হিসাবে দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা ১১ হাজারের মতো। তবে তাঁদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনের হিসাবে তা লাখের বেশি। বর্তমানে হিজড়াদের আদমশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এটি শেষ হলে তাঁদের সংখ্যাগত বিতর্কের অবসান ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কর্মসংস্থানে এখনো হিজড়া জনগোষ্ঠী পিছিয়ে থাকলেও যেটুকু পরিবর্তন এসেছে তাকেই ইতিবাচক মনে করেন বেসরকারি সংগঠন ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র নির্বাহী পরিচালক সালেহ আহমেদ। তিনি বলেন, পোশাকের বৈশ্বিক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম–এর বাংলাদেশ অফিস তাঁদের এই সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ করে আটজন হিজড়াকে চাকরি দিয়েছে। ডেলটা লাইফ ইন্স্যুরেন্সও একই ধরনের ইচ্ছার কথা জানিয়েছে।
গত ৮ মার্চ থেকে বেসরকারি বৈশাখী টেলিভিশনে রূপান্তরিত নারী তাসনুভা আনান শিশির সংবাদ পাঠিকা হিসেবে কাজ শুরু করেছেন; যা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম হয়েছে। সম্প্রতি আরেক রূপান্তরিত নারী হো চি মিন ইসলাম বেসরকারি স্কয়ার হাসপাতালের নিবন্ধিত নার্সের চাকরি ছেড়েছেন উচ্চতর পড়াশোনার জন্য। তাসনুভা ও হো চি মিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
রাজধানীতে বায়িং হাউস ফ্যাশন থিওরির অ্যাসিস্ট্যান্ট মার্চেন্ডাইজার নুসরাত জান্নাতের (রোজ) বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ছিল বিপুল। মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নুসরাত বললেন, ‘আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি সেখানকার মালিক বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাঁরা আছেন তাঁরা আমাদের বিষয়ে ইতিবাচক। তাই অন্যরা তেমনভাবে বা প্রকাশ্যে খারাপ ব্যবহার করতে পারেন না।’
উদ্যোক্তা হিসেবেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন অনেক হিজড়া সদস্য। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে তড়িৎ কৌশলে ডিপ্লোমা পাস জামালপুরের আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী নিজে উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি অন্য হিজড়াদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। আরিফা প্রথমবারের মতো ২০১৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ‘জয়িতা’ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ৫০ হাজার টাকা ও ক্রেস্ট নেন।
নিজেকে রূপান্তরিত নারী হিসেবে পরিচয় দেওয়া ডিগ্রি পাস তানিশা ইয়াসমিন চৈতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে ৯ মাস কাজ করেছেন। বর্তমানে রাজবাড়ীতে উত্তরণ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় বিউটি পারলার, বুটিক নিয়ে কাজ করছেন তিনি। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমানের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করা উত্তরণ ফাউন্ডেশন ২০১৬ সাল থেকে বিউটি পারলার পরিচালনা করছে। ফাউন্ডেশনের অধীনে বর্তমানে সাভারে নারীদের জন্য তিনটি ও মানিকগঞ্জে ছেলেদের জন্য একটি পারলার চালাচ্ছেন হিজড়া সদস্যরা।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিটি বর্তমানে ৬৪ জেলায় পরিচালিত হচ্ছে। এ কর্মসূচিতে কম্পিউটারসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৯ হাজার ১০০ জন। প্রশিক্ষণ শেষে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হচ্ছে তাঁদের।
চট্টগ্রাম কর্ণফুলী ইপিজেডে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডে জুনিয়র সেফটি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ৩ বছর ধরে কাজ করছেন রূপান্তরিত নারী সীমা আক্তার। তাঁর দায়িত্ব প্রায় ৩ হাজার কর্মীর দেখভাল করা। এইচএসসি পাস সীমা জানান, তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন যা পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহায়ক হয়েছে।
সীমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আমার কাজে দক্ষতা দেখিয়েছি। সবার কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। সবমিলে বেতন পাচ্ছি প্রায় ২০ হাজার টাকা। এখন অন্যের ওপর নির্ভরশীল বা ভিক্ষা করে খাচ্ছি না।’
গত ১ মার্চ থেকে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা পাস মারুফ কম্পিউটার অপারেটর আর অষ্টম শ্রেণি পাস জনি হোসেন অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন। জেলা প্রশাসক মো. আবদুল জলিল এ দুজনকে চাকরি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। সরকারি অফিসে হিজড়াদের নিয়োগ পাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নরসিংদীর মাধবদী পৌর শহরের ইসলাম প্লাজায় ‘ত্রিনয়ন রূপশিল্প’ নামের একটি রূপচর্চাকেন্দ্র (পারলার) করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত প্রথম রূপচর্চাকেন্দ্র এটি। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে হিজড়া জনগোষ্ঠীর ২০ জনকে আধাপাকা ঘর দেওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানে দেওয়া হয়েছে গবাদিপশু ও সেলাই মেশিন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কাজ করছেন ১১ জন হিজড়া। করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আগের পেশা বা যেসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিজড়ারা করতেন তা থেকে এই সদস্যরা সরে এসেছেন। সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের কর্মসংস্থানে এগিয়ে এলে হিজড়াদের বিরুদ্ধে প্রচলিত অভিযোগগুলোরও অবসান হবে।