- তথ্য অধিকার দিবস আজ
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তথ্য অধিকার হরণ
- হুমকির মুখে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা
- প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকা আরও সীমিত হয়ে যাবে
- মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও বাধার মুখে পড়বে
অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের কারণে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য পাওয়া এবং এর প্রয়োগ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। ব্রিটিশ আমলের এই সিক্রেটস অ্যাক্ট চলতি মাসে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যুক্ত করায় এ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন মহলে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী নেতারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিশ্লেষণ করে বলছেন, ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার প্রণয়ন করে তথ্য পাওয়ার যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল, এই আইনের মাধ্যমে তা কার্যত হরণ করা হলো। তথ্যের অধিকার, তথ্যকর্মীদের নিরাপত্তা ও তথ্যের গোপনীয়তা—এই তিনটি বিষয় সাংবাদিকতাকে একটি বৃত্তে আটকে ফেলছে। হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এমনকি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও বাধার মুখে পড়বে। আর প্রেস কাউন্সিলের ভূমিকা আরও সীমিত হয়ে যাবে।
একটি আইনের কিছু ধারা গণমাধ্যম, মুক্তচিন্তা এবং বাক্স্বাধীনতাকে কীভাবে গিলে ফেলতে পারে, তার দৃষ্টান্ত সামনে নিয়ে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। ২০০২ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ দিবসটি পালন করে আসছে।
জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, গত নয় বছরে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্য সংগ্রহে কেউ বাধার সম্মুখীন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। তাঁর দাবি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রাচীন অ্যাক্টটি অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাতে তথ্য পেতে সমস্যা হবে না। এ বিষয়ে সরকার সাংবাদিকদের আপত্তি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও পরামর্শ আমলে নিয়েছে। আগামী রোববার সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক করা হবে।
গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, ২০০৯ সালে এই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই সাংবাদিকেরা তথ্য অধিকার আইন পেয়েছিলেন। অথচ এক দশকের মাথায় একই সরকারের মাধ্যমেই পাচ্ছেন তথ্য গোপন বা চেপে রাখার আইন।
তথ্য অধিকার আইনটি ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। সীমিত পরিসরে হলেও আইনটির চর্চা হচ্ছিল। আইনে ২০টি বিষয়ে তথ্য দেওয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, পররাষ্ট্রনীতি, জননিরাপত্তা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, আইন দিয়ে সংরক্ষিত গোপনীয় তথ্য ইত্যাদি। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দাকাজে নিয়োজিত আটটি সংস্থাকে তথ্য অধিকার আইনের বাইরে রাখা হয়। আইনে মন্ত্রিপরিষদ বা উপদেষ্টা পরিষদের সারসংক্ষেপ, দলিল বা আলোচনার প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়। তবে আইনে এ–ও বলা হয়, মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ এবং যেসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা প্রকাশ করা যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তথ্যমন্ত্রী এবং গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ড. মীজানুর রহমান শেলী প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি করার পেছনে সরকারের অনেক ব্যাখ্যা আছে। একটি আইন দরকারও বটে। কিন্তু সাদাচোখে দেখলে বলা যায়, এই আইনের লক্ষ্য মানুষের স্বাধীন চেতনা, মতামত বা অভিব্যক্তিগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। একটি গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজে এমন আইন থাকতে পারে না।
গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তথ্য অধিকার আইন হলেও গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতা হলো, সরকারি দপ্তরে মানুষ সহজে তথ্য পায় না। অনেক দপ্তর তথ্য দিতে চায় না। তার ওপর অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের থাবায় তথ্য অধিকার আইনটি আরও নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে।
এরই মধ্যে দেশের সম্পাদক, সাংবাদিক ইউনিয়নসহ গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান নিয়েছে। প্রতিবাদে সম্পাদক পরিষদ ২৯ সেপ্টেম্বর মানববন্ধন ডাকার পর সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিক ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহ দেখানোর পর কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।
আইনটি চূড়ান্ত করার আগে সংসদীয় কমিটি সম্পাদক পরিষদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সঙ্গে বৈঠক করে। এসব সংগঠনের প্রতিনিধিরা যেসব প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সরকারের প্রতিনিধিরা তা মানার আশ্বাস দিলেও তা মানা হয়নি।
আরও আছে সম্প্রচার নীতি ও আইন
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর আগে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাও করেছে সরকার, যার অনেকগুলো ধারা তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমনকি জাতীয় সম্প্রচার কমিশন আইনের যে খসড়া করা হয়েছে, সেটিও তথ্য অধিকার আইনের বিভিন্ন ধারাকে অকার্যকর করার জন্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং জাতীয় সম্প্রচার আইনের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় সাংঘর্ষিক। কিছু বিষয়ে পুনরাবৃত্তিও রয়েছে। যে কারণে সম্প্রচার আইন তৈরি করে রাখা হলেও এটি সংসদে পাঠানো হচ্ছে না।
অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে আপত্তি কেন
১৯২৩ সালের এই বিতর্কিত আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো সংবাদ পেয়ে থাকলে সেই সংবাদ প্রকাশ করতে পারবে না। গোপন সংবাদ প্রকাশ করলে সংবাদপত্রের প্রতিবেদক, সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রকাশক অপরাধী হবেন, এ জন্য জেল-জরিমানার বিধান আছে। আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় কিংবা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করে বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে তবে সে অপরাধী হবে। ৩(ক) ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নকশা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না।
আর্টিকেল ১৯-এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক পরিচালক তাহমিনা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তথ্য অধিকার আইন করা হলেও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাতিল করা হয়নি। তাই এটি প্রয়োগ না হলেও কার্যকর রয়েছে।
সবাই বিপক্ষে
ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলটি পাস হওয়ার পর এক ডজনের বেশি সংগঠন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সরকারি কোনো সংগঠন পর্যন্ত আইনটিকে স্বাগত জানায়নি। জাতীয় সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কয়েকজন সাংসদও আইনটির বিরোধিতা করছেন।
সম্পাদক পরিষদ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিজম (আইএফজে), পেন ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশ ডিজিটাল আইন নিয়ে উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, অধিকার থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অব্যাহত আছে।
৫৭ ধারা নিয়ে যা কিছু
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে দেশজুড়ে আপত্তি ওঠায় এবং অপপ্রয়োগের কারণে এই ধারাসহ আইনের কয়েকটি ধারা বাতিলের ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু নতুন আইনে বিতর্কিত ৫৭ ধারার বিষয়গুলো চারটি ধারায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে তিন-চারটি বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে পুলিশের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা। আইনে কারও অনুমোদন ছাড়াই পুলিশকে তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটি ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমোদন নেওয়ার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করলেও তা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। ফলে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশের কারও অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনা থেকে শিখেছি যে যখনই কোনো রাষ্ট্র স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করতে থাকে, তখনই সেই রাষ্ট্রকে পুলিশি রাষ্ট্র বলা হয়। দেখা যায়, রাষ্ট্রের অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের শান্তি, শৃঙ্খলা ও সুশাসন বজায় রাখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ গৌণ করে ফেলা হয়। শুধু যারা জোর খাটাতে পারে, অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে, সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর রাষ্ট্র পরিচালকেরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন তারাই ক্ষমতা খাটানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টার মতে, এটা গণতন্ত্রের সঙ্গে পুরোপরি সাংঘর্ষিক। কারণ, গণতন্ত্রের মূল শর্ত হচ্ছে সম্মতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা। পুলিশ নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাদের নির্দিষ্ট কতগুলো ভূমিকা আছে। তারা কখনো নির্বাহী, বিচার বিভাগ এবং আইনপ্রণেতার ভূমিকায় যেতে পারে না। পুলিশকে যখন ঢালাওভাবে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, তখন বিষয়টি সেখানে গড়াচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এমন ব্যবস্থা অনুমোদন করে না।