আমরা মিডিয়াকর্মীরা আজ বড় বিপদগ্রস্ত। এই কোভিডকালে অন্য সব পেশাজীবীও একইভাবে বিপদগ্রস্ত। এই বিপর্যয় থেকে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো খুবই দরকার, নইলে অকূলপাথারে পড়তে হবে। প্রথমে সিনেমার কথায় আসা যাক। সবাই বলে থাকেন, আমাদের সিনেমার অবস্থা বেহাল। এ প্রসঙ্গে আমি একটু ভিন্নমত পোষণ করি। আমার মনে হয়, আমরা একটা ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সাম্প্রতিক কালে বাংলা সিনেমা তার নতুন অবয়ব খুঁজে নিচ্ছিল। কোভিডের আগের কাল—আমরা যদি ২০১৯ সালের কথাই ধরি, কম করে হলেও আশাজাগানিয়া ১০টি সিনেমা নির্মাণাধীন ছিল। কারও দ্বিতীয় বা তৃতীয় সিনেমা—যাঁরা প্রত্যেকে সফল নির্মাতা ছিলেন। আর যাঁরা প্রথম সিনেমা বানাতে এসেছেন, তাঁরাও ভীষণ সম্ভাবনাময়। সিনেমা বানানোর ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিয়েই তাঁরা মাঠে নেমেছিলেন। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, একে একে ১০টি মৌলিক বাংলা সিনেমা রিলিজ হলো, এক-দুটি হিট করল, দু-তিনটি মোটামুটি ব্যবসা করল, দু-তিনটি ব্রেক ইভেনে পৌঁছাল, দু–একটা লস করল। এতে ‘শুয়ে পড়া’ বাংলা সিনেমা নতুন করে হাঁটা শিখত। এ আমার সরল ভাবনা। কষ্টকল্পনাও বলতে পারেন।
এবার বাস্তবে আসি, সত্যিই সিনেমার অবস্থা আজ বেহাল। ৩৫ মিলিমিটার থেকে ডিজিটাল উত্তরণযাত্রায় গত এক দশকের মধ্যেই ৬০০ সিনেমা হলের জায়গায় শ খানেক টিকে আছে। অন্যদিকে এক–দুটি করে মাল্টিপ্লেক্স গড়ে উঠছিল, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ১৬ কোটি মানুষের দেশে বর্তমানে ২০টিও মানসম্মত সিনেমা হল নেই। পূর্বের রুগ্ণতা ও বর্তমানের স্থবিরতায় আমরা সত্যিই দিশেহারা। তবে আশার কথা, এই দিশেহারা অবস্থায় সরকার সিনেমার জন্য এক হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এই ঋণের টাকায় ৬৪টি জেলায় যদি ৩০০–৪০০ আসনের দুই স্ক্রিনের মাল্টিপ্লেক্স করা যায়, তাহলে আমাদের সিনেমা ঘুরে দাঁড়াতে বাধ্য। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলোর সংস্কার করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা। শুধু সিনামা হল গড়লে তো হবে না, সিনেমাও লাগবে। সরকারি বরাদ্দের কিছু অংশ সিনেমা প্রযোজনার ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া যেতে পারে, এতে সাপ্লাই চেইন ঠিক থাকবে।
এরপর আসি সিনেমা পরিবেশনের বিষয়ে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে সিনেমাবাণিজ্য সত্যিই আজ করুণ। বুকিং এজেন্ট থেকে শুরু করে সার্ভার ও প্রজেক্টরের মালিকের কাছে প্রযোজকেরা আজ জিম্মি। ডিস্ট্রিবিউশন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন দরকার। বিএফডিসির তত্ত্বাবধানে সেন্ট্রাল সার্ভার নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। সঙ্গে ই-টিকেটিংয়ের ব্যবস্থা করলে আমাদের সিনেমার দিন ফিরতে বাধ্য। পাশাপাশি সারা বিশ্বের সিনেমা আমাদের দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।
আমাদের সিনেমা সূচনালগ্ন থেকেই ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজের জায়গা পোক্ত করে নিয়েছিল।
আরেকটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের বাংলা সিনেমা বিশ্বের দরবারে হাজির–নাজির থাকছে। কয়েকজন মেধাবী নির্মাতা নানা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশকে সিনেমার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরছেন। এ ধরনের সিনেমার জন্য প্রণোদনার কিছু অংশ শূন্য সুদে ঋণ দেওয়া গেলে বাণিজ্যের বাইরেও আমাদের উদ্ভাবনশীল নির্মাতারা বিশ্ব চলচ্চিত্রশিল্পে মৌলিক অবদান রাখতে পারবেন। সিনেমা নিয়ে অনেক কথা হলো, এবার টেলিভিশন নিয়ে দু–চারটি কথা বলা যেতে পারে।
দায়সারা গোছের বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশের টেলিভিশনের নাটক আজ রুগ্ণ। এই খামখেয়ালির দায় টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ ও বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর যেমন বর্তায়, তেমনি নীতিনির্ধারকদের ওপরও বর্তায়। ঘরে ঘরে লোকজন পয়সা দিয়ে টিভি দেখে ডিশওয়ালাদের মাসিক ভিত্তিতে টাকা দেন। সেই টাকা শুধু ডিশওয়ালারা খাবে কেন? টেলিভিশনগুলো কেন তার ভাগ পাবে না? হ্যাঁ, আমি পে-চ্যানেল ধারণার কথা বলছি। এতে বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে।
এবার বাস্তবে আসি, সত্যিই সিনেমার অবস্থা আজ বেহাল। ৩৫ মিলিমিটার থেকে ডিজিটাল উত্তরণযাত্রায় গত এক দশকের মধ্যেই ৬০০ সিনেমা হলের জায়গায় শ খানেক টিকে আছে। অন্যদিকে এক–দুটি করে মাল্টিপ্লেক্স গড়ে উঠছিল, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
টেলিভিশনগুলো উপযুক্ত বাজেটে মানসম্পন্ন প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারবে। বাংলাদেশের টেলিভিশন বেঁচে যাবে।
সবশেষ সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিয়ে লেখাটা শেষ করব। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এক ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম মান্দারিন ভাষা। ওয়েবে তারা কী করছে, আমার জানা নেই। কারণ, চীন সম্পর্কে আমরা কমই জানতে পারি। যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ভাষা হচ্ছে স্প্যানিশ, ইংরেজি ও হিন্দি। এই তিন ভাষার ওয়েব কন্টেন্ট সারা পৃথিবী মাতিয়ে বেড়াচ্ছে। তার পরের স্থানটি, অর্থাৎ পঞ্চম বৃহত্তর বাংলাভাষী জাতি হচ্ছে বাঙালি। বর্তমানে প্রায় ৩৫ কোটি বাঙালি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। কল্পনা করতে পারেন? পৃথিবীর মতো জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে। আর সব ভাষাভাষী জাতি নিজের ভাষায় বিনোদিত হতে ভালোবাসে।
এখন সময় হচ্ছে বাংলার। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নিজেদের হিস্যাটা বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে। দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বর্তমানে কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমাদের নির্মাতারা টুকটাক কাজও করছেন। আমার বিশ্বাস, ওয়েব–বান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করা গেলে অদূর ভবিষ্যতে এ দেশেই বিশ্বমানের ওটিটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠবে আর বাংলা বিনোদনের রাজধানী হবে ঢাকা।
● গিয়াস উদ্দিন সেলিম চলচ্চিত্র নির্মাতা