ডেঙ্গুর এই আক্রমণ আগে দেখেননি চিকিৎসকেরা
‘২০১৯ সালে ৫ দিনের আগে অবস্থা খারাপ হতো না। এবার ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে ব্লাড প্রেশার কমছে, পেটে ও বুকে পানি চলে আসছে, শকে চলে যাচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আগে চার দিনে আমরা ক্রিটিক্যাল কিছু কল্পনা করতাম না,’ ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে কথাগুলো বলেছেন পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
তাঁর মতো ঢাকার আরও কয়েকটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এবার ডেঙ্গুতে অসুস্থতা নিয়ে এ ধরনের কথা বলেছেন। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত এসব চিকিৎসকের ভাষ্যমতে, এবার মশাবাহিত এই ভাইরাস সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থতার হারও বেড়েছে। আগে যেখানে শকে যাওয়া শিশুদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ শতাংশের মস্তিষ্ক ও হৃদ্যন্ত্রে জটিলতা হতো, এবার সেই হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) সাম্প্রতিক এক গবেষণাগায়ও উঠে এসেছে, এবার ডেঙ্গু অন্যবারের চেয়ে ভয়ানক। খুব তাড়াতাড়ি রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। সেখানকার বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেঙ্গুর চারটি ধরন শনাক্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মারাত্মক ক্ষতিকর ধরনের একটি ডেনভি-৩–এ অধিকাংশ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ২০১৯ সালেও ডেঙ্গুর এই ধরনের দাপট দেখা গিয়েছিল। সে বছরই বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। আক্রান্তও হয়েছিল সবচেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে চলতি বছর মোট ১০ হাজার ৬৫১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তাদের মধ্যে ৭ হাজার ৬৯৮ জন রোগী এসেছেন গেল আগস্ট মাসে। সরকারি হিসাবে এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৪৫ জন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত অনেক বেশি ছিল, সেই তুলনায় সংকটাপন্ন রোগীর হার কম ছিল। কিন্তু এবার শনাক্ত তুলনামূলকভাবে কম, কিন্তু জটিলতা বেশি।
ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন মিটফোর্ড হাসপাতাল ও ঢাকা শিশু হাসপাতালে। গত মাসে শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় চার মাসের শিশু আহমাদের। হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) এবং সেখান থেকে লাইফ সাপোর্টে নিয়েও ডেঙ্গু থেকে বাঁচানো যায়নি শিশুটিকে।
শিশুটির বাবা নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গত ৫ আগস্ট আহমাদের জ্বর আসে। নাপা সিরাপ খাওয়ানোর পরই তাঁর জ্বর সেরে যায়। পরে শরীর বেশ ঠান্ডা হয়ে যায়। এর চার দিন পর হয় খিঁচুনি। তখন নেওয়া হয় হাসপাতালে। পরে রক্ত, প্লাটিলেট দিয়েও বাঁচানো যায়নি।
শিশুটির চিকিৎসা করেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার পেডিয়াট্রিকস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটি যখন আসে তখন তার মস্তিষ্কে সমস্যা দেখা দিয়েছে। একে বলে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। এ ছাড়া ছিল খিঁচুনি, জ্বর, নিউমোনিয়া ও রক্তে সংক্রমণের মাত্রা বেশি। জটিলতা বেশি থাকায় বাঁচানো যায়নি তাকে।
ডেঙ্গুর জটিলতা যেভাবে বাড়ে
এত দিন আক্রান্তের দেহে এই ভাইরাস সংক্রমণের পর্যায়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্য জটিলতা সম্পর্কে সজাগ থাকতেন চিকিৎসকেরা। ন্যাশনাল গাইডলাইন ফর ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট অব ডেঙ্গু সিনড্রোম ২০১৮ অনুসারে, সংক্রমণের চারটি পর্যায়ের প্রথমটিতে জ্বর হয়, যা অন্যান্য ভাইরাল জ্বর থেকে আলাদা করা কঠিন হয়। দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গু জ্বর; এখানে জ্বরের সঙ্গে নাক, মুখ, পাকস্থলী ও খাদ্যনালিতে রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে, আবার দেখা না–ও দিতে পারে।
গাইডলাইন অনুসারে, তৃতীয় পর্যায়ে রক্তক্ষরণের পাশাপাশি রক্তরস (প্লাজমা) লিকেজ হয় বা শিরা-উপশিরা ছিদ্র হয়ে রক্তরস বেরিয়ে যায়। এ কারণে প্লাটিলেট ও শ্বেত রক্তকণিকা কমে যায়, বাড়ে হিমোগ্লোবিন। এর প্রভাবে অনেকে শকে চলে যান অর্থাৎ হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়, শিরার গতি বেড়ে যায়, রক্তচাপ কমে যায়। আবার কেউ শকে যান না। শকে চলে যাওয়াকে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।
চতুর্থ ও ভয়াবহ পর্যায় হলো এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। গাইডলাইন অনুসারে, এ পর্যায়ে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডে সমস্যা দেখা দেয়। এই অবস্থা ‘খুবই বিরল’।
ওই গাইডলাইন অনুসারে, ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত চতুর্থ দিনের মধ্যেই কমে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জ্বরের পরই অনেকে সুস্থ হয়ে যান। তবে সুস্থ না হলেও শরীরের তাপমাত্রা কমতে থাকে। পঞ্চম থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত সংকটকালীন পর্যায়। তখন প্লাজমা লিকেজ শুরু হয় এবং পরবর্তী জটিলতাগুলো ধারাবাহিকভাবে দেখা দেয়।
কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুতে অসুস্থতা এই ধারাবাহিকতা মেনে হচ্ছে না। তা ছাড়া গাইডলাইনে রোগীদের মাঝে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম ‘খুবই বিরল’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এবার তা বেশি দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে।
মস্তিষ্ক ও হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা বেশি
ঢাকা শিশু হাসপাতালের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (এনআইসিইউ) এবং শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) শিশুদের চিকিৎসার দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার আগের সমস্যার পাশাপাশি রোগীরা হৃদ্যন্ত্র ও মস্তিষ্কে সমস্যা নিয়ে বেশি আসছে। হৃৎপিণ্ডে পানি জমা, হার্ট ব্লক প্রকট আকার ধারণ করেছে।’
তাঁর পর্যবেক্ষণ, এবার ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের রোগীদের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম দেখা যাচ্ছে। গতবার এটা ছিল ৫ থেকে ১০ শতাংশ।
অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন বলেন, ‘গত বছরগুলোর চেয়ে এ বছর জ্বরের সময়ই শকে চলে যাচ্ছে। এবার ট্রেন্ডটা ভয়ানক।’
এ ছাড়া বয়সের তুলনায় স্থূলকায় শিশুদের অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে জানিয়েছেন এ শিশু বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘এখন দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ করেই ব্লাড প্রেশার (রক্তচাপ) নেই।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সোমবারের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ৪২৪টি শিশু এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে ৬ জন।
‘শকে’ চলে যাচ্ছে দ্রুত
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সোমবারের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৬০৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন ৭ জন। কোনো হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির দিক দিয়ে এটাই সর্বোচ্চ।
হাসপাতালটিতে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের চিকিৎসা হচ্ছে পৃথক স্থানে। হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘এ বছর রক্তক্ষরণের চেয়ে রোগী শকে চলে যাচ্ছে বেশি। এ ধরনের রোগীর যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে দ্রুত চিকিৎসা না নিলে।’
বেশি অবনতি হওয়া শিশুদেরই শুধু হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে বলে জানান এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ভর্তি করা শিশুদের মধ্যে শকে গেছে প্রায় অর্ধেক রোগী। ২০১৯ সালে সংখ্যাটা ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছিল।
এবার ভর্তি হওয়া শিশুদের অনেকেই ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে বলে জানান ডা. মো. ইব্রাহিম খলিল। তিনি বলেন, ‘এটা এবার বেশি হচ্ছে।’
শিশু ইউনিটের বাইরে আলাদা একটি ইউনিটে ডেঙ্গুর চিকিৎসা হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্কদের। সেখানকার ফোকাল পারসন (মুখপাত্র) ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, এবার জ্বর শুরু হওয়ার ৩ দিনের মধ্যেই এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৯ সালে এই পরিস্থিতি তৈরি হতে ৬ থেকে ৭ দিন লাগত।
এর বাইরে এবার দ্রুত প্লাটিলেট কমে যাওয়ার নজির পাচ্ছে মিটফোর্ড হাসপাতাল। মূলত মানুষের স্বাভাবিক প্লাটিলেটের পরিমাণ দেড় লাখ থেকে চার লাখ। এত দিন প্লাটিলেট ২০ হাজারে নামতে অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগত। এবার তেমনটা ২–৩ দিনেও ঘটেছে বলে জানান ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
জটিলতা কেন বাড়ছে
এখন ডেঙ্গু রোগীরা অল্প সময়ের মধ্যেই কেন গুরুতর অসুস্থ হচ্ছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মো. টিটো মিঞার কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুত শকে চলে যাওয়ার ঘটনা তাঁরা ২০১৯ সালের শেষের দিকে পেয়েছিলেন। এবার আবার দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুর ধরনের কারণে জটিলতায় পার্থক্য হয় কিছুটা। তা ছাড়া কেউ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তাঁর জটিলতা বেশি হয়। এ ছাড়া ভাইরাসটির বিরুদ্ধে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা যুদ্ধ করার সময় কিছু প্রতিক্রিয়া হয়। এসব কারণেও জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘(এবার) রোগীর সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে কম। তবে আমরা দেখছি, একটু বেশি অসুস্থ হয়েই এবার হাসপাতালে রোগীরা ভর্তি হয়েছে। খুব দ্রুত যদি হাসপাতালে না আসে, অন্যেরটা দেখে চিকিৎসা নেয়, তাহলে অবস্থা খারাপ হয়।’
নাজমুল ইসলাম বলেন, জটিলতা বাড়ার একটা কারণ হচ্ছে, অনেকে দেরি করে আসছে। সবাই করোনাভাইরাসের পরীক্ষা আগে করে, ফল নেগেটিভ হলে ক্ষান্ত দেয়। এর অনেক পরে ডেঙ্গুর টেস্ট করছে।
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় দফায় আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। সে কারণে রোগী এর আগেও আক্রান্ত হয়েছে কি না বা একই ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন কি না, এগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হবে। এ জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ইতিমধ্যে অনেক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাঁদের অভিমত পেলে বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হবে।