ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: করোনাকালেও বেড়েছে মামলা ও গ্রেপ্তার
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতেও দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত ৭১ দিনে এই আইনে মামলা হয়েছে ৪৩টি। এর আগে ২০১৯ সালে বছরজুড়ে এই সংখ্যা ছিল ৬৩।
করোনাকালে দায়ের হওয়া মামলায় পেশাজীবী হিসেবে সবচেয়ে বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে সাংবাদিক। এ সংখ্যা ১২ জন। মামলাগুলোর অধিকাংশই করেছেন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ও পুলিশ।
দেশে গত মার্চে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল ১১টি। এপ্রিলে তা বেড়ে হয় ১৮। আর চলতি মে মাসের প্রথম ১০ দিনেই মামলা হয়েছে ১৪টি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল ১৯ এবং পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশের মুখপাত্র ও পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, সাইবার অপরাধ নিয়ে তাঁদের প্রতিটি ইউনিটেই পর্যবেক্ষণ দল আছে। পুলিশ সদর দপ্তরের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ সেল থেকে এগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় করা হয়। কেউ গুজব ছড়াচ্ছে বলে নিশ্চিত হলে প্রথমে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি ব্লক করতে বিটিআরসিকে বলা হয়। একই সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হয়।
গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত হওয়া ৪৩টি মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর ১১টি হয়েছে করোনাভাইরাস নিয়ে ‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে। ছয়টি মামলা হয়েছে মন্ত্রী, সাংসদ বা স্থানীয় মেয়রকে জড়িয়ে ‘মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন’ বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে। ত্রাণ চুরি নিয়ে ‘মিথ্যা তথ্য’ ছড়িয়ে দেওয়া ও সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে পাঁচটি, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে তিনটি, ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে তিনটি, পুলিশের সমালোচনা করে সংবাদ পরিবেশন ও ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে চারটি, চিকিৎসার সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় একটি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী নিয়ে সমালোচনা করায় দুটি, ‘চাঁদা না পেয়ে সংবাদ পরিবেশনের’ অভিযোগে একটি এবং ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে একটি মামলা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক গোলাম রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রণয়নের সময় এই আইনের অপব্যবহার হবে না বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এখন তো দেখা যাচ্ছে শুধু অপব্যবহারই না, স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে চলে গেছে। মামলাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হচ্ছে।
করোনা নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গত ১৭ মার্চ প্রথম মামলাটি হয় গাজীপুরের শ্রীপুরে। ফেসবুকে করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও চিকিৎসা নিয়ে স্ট্যাটাস দেওয়ায় উপজেলা নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত মঙ্গলবার রাজধানীর রমনা থানায় র্যাবের করা মামলায় কার্টুনিস্ট, লেখক ও প্রবাসী সাংবাদিকসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কুমিল্লা-৫ আসনের সাংসদ আবদুল মতিন খসরু করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন—ফেসবুকে এমন একটি স্ট্যাটাসের নিচে মন্তব্য করে গত ৯ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন কুমিল্লার ফরহাদ খান ও মাহফুজ বাবু। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার বাদী ছাত্রলীগের এক নেতা। সরকারদলীয় এক সাংসদের কাঁচা ধান কাটার ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করায় গত বুধবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজধানীতে সাইবার জগতের ওপর নজর রাখে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার অপরাধ বিভাগ। এই বিভাগের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা গুজব ছড়িয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু লোক সত্য-মিথ্যা না জেনেই এসব করেছেন। তবে অনেকে আছেন, সব সময় অভ্যাসবশত এমনটা করে থাকেন। যাঁরা না জেনে করেছেন, এমন অনেককে তাঁরা ডেকে এনে বুঝিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব মামলার ১৭টি করেছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, সদস্য, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক এবং বর্তমান নেতা। কিশোরগঞ্জে ভৈরবে একটি মামলা করেছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। করোনার স্থানীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেন। ২৪টি মামলা করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৫২ জন। তাঁদের মধ্যে ১২ জন সাংবাদিক। সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ৪ মে রাতে মাহতাব উদ্দিন তালুকদার নামে স্থানীয় এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। কথা না বলেই সংবাদে পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য জুড়ে দেওয়া হয়েছে; এমন অভিযোগে ১ মে নরসিংদীতে গ্রেপ্তার হন তিন সাংবাদিক। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলায় পৃথক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন একজন করে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য, আইনজীবী, প্রভাষক, ইমাম, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী এবং দুজন ছাত্র। বাকিদের পেশা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার পর থেকেই বাক্স্বাধীনতা বন্ধ করতে এর যে ধারাগুলো রয়েছে সেগুলো নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। মহামারির এই সময়েও আইনটির সর্বোচ্চ প্রয়োগ হচ্ছে।