একাত্তরের ২৫ মার্চ ঢাকায় লুকিয়ে থেকে গিয়েছিলেন ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর তৎকালীন প্রতিনিধি সাইমন ড্রিং। ৩০ মার্চ বের হয় তাঁর লেখা পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন
আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ভয়ের নগরী।
ঠান্ডা মাথায় পাকিস্তানি সৈন্যরা টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর নগরীর সাত হাজার মানুষ নিহত, বিশাল বিস্তৃত এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার লড়াইকে নির্মমভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দাবি করেছেন বটে যে পরিস্থিতি এখন শান্ত, তবু রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে গ্রামমুখী হাজার হাজার মানুষ। শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানে হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে।
তবে সন্দেহ নেই যে ট্যাংকের মদদপুষ্ট সৈন্যদল শহর ও অন্যান্য লোকালয় নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ খুব কমই। যেটুকু প্রতিরোধ এখানে-সেখানে চলছে, সেটুকু কার্যকর নয়। কারণে-অকারণে গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে, বাড়িঘর নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সৈন্যদের দেখে মনে হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিদিনই সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।ঠিক কত নিরীহ মানুষ এ পর্যন্ত জীবন দিয়েছে, সে হিসাব করা খুবই কঠিন। তবে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর ও ঢাকার হিসাব যোগ করলে এ সংখ্যা ১৫ হাজারে দাঁড়াবে। যা মাপা যায়, তা হলো সামরিক অভিযানের ভয়াবহতা। ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে তাদের বিছানায়, কসাই নিহত হয়েছে তার ছোট্ট দোকানটিতে, নারী ও শিশু ঘরের ভেতর জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানিদের একসঙ্গে জড়ো করে মারা হয়েছে, বাড়িঘর-বাজার-দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে আর পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে সব ভবনের শীর্ষে। সরকারি সৈন্যদের দিকে হতাহতের সংখ্যা স্পষ্ট নয়। তবে শোনা যাচ্ছে, একজন অফিসার নিহত এবং দুজন সৈন্য আহত হয়েছে।বাঙালির অভ্যুত্থান সত্যিকার অর্থেই এবং ভালোভাবে দমন করা গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
২০০ ছাত্র নিহত
মাঝরাতের ঠিক পরপরই আমেরিকার দেওয়া বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এম-২৪ ট্যাংকের ছত্রচ্ছায়ায় এক কলাম সৈন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করে। সৈন্যরা ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখল করে সেটিকে ঘাঁটি বানিয়ে ছাত্রাবাসগুলোতে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। সরকারবিরোধী জঙ্গি ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি বলে পরিচিত ইকবাল হলে গোলা নিক্ষেপ করে আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিতে ২০০ ছাত্র নিহত হয়। এ ধরনের হামলায় নিরস্ত্র ছাত্ররা স্পষ্টতই বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল।
দুই দিন পরও দেখা গেছে পোড়া রুমের মধ্যে পড়ে থাকা লাশ, বারান্দায় আর মাঠে লাশ; সবচেয়ে বেশি লাশ ছিল হলের পাশের লেকে। চিত্রকলার এক ছাত্রের লাশ উপুড় হয়ে পড়ে ছিল তার ক্যানভাসের ওপর। কোয়ার্টারে বসবাসকারী সাতজন শিক্ষক নিহত হন। প্রাঙ্গণে ১২ সদস্যের একটি পরিবারকে গুলি করে মারা হয়। অন্য একটি হলে ছাত্রদের মেরে দ্রুত কবর খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে তারপর ট্যাংক দিয়ে মাটি সমান করে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ লোকজনকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। একটি রেললাইন বরাবর ২০০ গজ এলাকার বস্তিঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নিকটস্থ একটি মার্কেটও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দোকানের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা লোকজন মেশিনগানের গুলিতে প্রাণ হারায়। কাঁধ পর্যন্ত টেনে দেওয়া কম্বলের তলায় মনে হচ্ছিল তারা যেন ঘুমিয়েই আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বাজুকা ছোড়া হয়। একটি মসজিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর আক্রান্ত
একদিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রান্ত হয়, অন্যদিকে আরেক কলাম সৈন্য পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদর দপ্তর রাজারবাগ আক্রমণ করে। ট্যাংক প্রথমে গোলাবর্ষণ করে। পরে সৈন্যরা ঢুকে ঘুমন্ত পুলিশের ব্যারাক মাটির সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। এই হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছিল, তার সঠিক হিসাব যদিও জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই সময় সেখানে অবস্থানকারী ১ হাজার ১০০ পুলিশের মধ্যে অল্প কজনই রেহাই পেয়েছিল।
এ অবস্থার মধ্যে অন্য ইউনিটগুলো শেখ মুজিবের বাসভবন ঘিরে ফেলে। রাত একটার ঠিক আগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি অনেক আগেই এ ধরনের হামলার আশঙ্কা করছিলেন এবং কয়েকজন কাজের লোক ও দেহরক্ষী বাদে অন্যদের অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছিলেন। মুজিবের এক প্রতিবেশী জানান, রাত ১টা ১০ মিনিটে একটা ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্রাকবোঝাই সৈন্যরা গুলি করতে করতে মুজিবের বাড়ির দিকে এগোতে থাকে। বাড়ির সামনে এসে একজন অফিসার রাস্তা থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ‘শেখ মুজিব, আপনি বাইরে বেরিয়ে আসুন।’ ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে মুজিব বলেন, ‘হ্যাঁ আমি প্রস্তুত। এত গোলাগুলির দরকার ছিল না। আমাকে ফোন করলে আমি নিজেই হাজির হতাম।’
অফিসারটি এরপর বাড়ির বাগানে ঢুকে বলল, ‘আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো।’ তিনজন কাজের লোক, একজন সহকারী আর দেহরক্ষীসহ মুজিবকে তারা নিয়ে গেছে।
সব দলিলপত্র নিয়ে যাওয়া হলো
শেখ মুজিবকে সেনা সদর দপ্তরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। আরেক দল সৈন্য ঢোকে বাড়ির ভেতরে। তারা বাড়িতে রক্ষিত দলিলপত্র নিয়ে যায়, চোখের সামনে যা পায় তা-ই ভাঙচুর করে, বাগানের দরজায় তালা লাগিয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের লাল-সবুজ-হলুদ পতাকা গুলি করে নামিয়ে ফেলে।
রাত দুইটা নাগাদ সারা ঢাকা পরিণত হয় জ্বলন্ত নগরীতে। সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকা দখল করে নেয় এবং লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের গুলি করে মারতে ও স্বাধীনতার পতাকা বদলে পাকিস্তানি পতাকা ওড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনো কোনো এলাকায় মাঝে মাঝে ভারী অস্ত্রের গর্জন শোনা গেলেও বোঝা যাচ্ছিল যে যুদ্ধের তীব্রতা কমে এসেছে। ইতিমধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উল্টোদিকে খালি পড়ে থাকা পিপল পত্রিকার অফিসে এক প্লাটুন সৈন্য ঢুকে সেটিকে জ্বালিয়ে দেয় এবং সেই অফিসের একমাত্র নৈশপ্রহরীকে গুলি করে হত্যা করে।
সকাল নাগাদ গোলাগুলি প্রায় থেমে গেল। যত বেলা বাড়তে লাগল, শহরজুড়ে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা জেঁকে বসল—যেন মৃত নগরী। থেমে থেমে কাকের ডাক আর সশব্দ সামরিক গাড়ির অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবে সবচেয়ে খারাপটা তখনো বাকি ছিল। মাঝদুপুর নাগাদ বিনা নোটিশেই কয়েক সারি সৈন্য ঢাকার পুরান অংশে হামলা চালায়। সেখানে সংকীর্ণ অলিগলিতে প্রায় ১০ লাখ লোকের বাস। পরবর্তী ১১ ঘণ্টা ধরে পাকিস্তানি সেনারা ওই সব এলাকায় বেশ গুছিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। মুজিবের সমর্থকদের সবচেয়ে শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল ওই সব এলাকা। ইংলিশ রোড, নয়াবাজার, ফ্রেঞ্চ রোড, সিটি বাজার এলাকায় হাজার হাজার লোকের বাসস্থান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ফ্রেঞ্চ রোড-নয়াবাজার এলাকায় এক বৃদ্ধের ভাষায়, ‘গলির মাথায় ওরা হঠাৎ যেন উদিত হচ্ছিল আর সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছিল।’
প্রথমে আসত একদল সৈন্য। তাদের অনুসরণ করত পেট্রলের টিন হাতে আরেক দল। তারা আগুন লাগিয়ে দিত। যারা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করত, তাদের গুলি করা হতো। যারা ভেতরে থাকত, তারা জীবন্ত দগ্ধ হতো। ওই দিন বেলা দুইটার মধ্যে পুরান ঢাকার ৭০ জন নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। প্রায় একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় অন্য আরও তিনটি এলাকায়। সৈন্যরা চলে যাওয়ার সময় যতটা পারত লাশ তুলে নিয়ে যেত তাদের ট্রাকে। এভাবে তারা যেত এক টার্গেট থেকে আরেক টার্গেটে। পুরান ঢাকায় তারা একটি থানায়ও হামলা চালায়। একটি বাজারের ধ্বংসস্তূপে দেখা হলো এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমার কনস্টেবলদের লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার সঙ্গে ২৪০ জন ছিল। এ পর্যন্ত ৩০ জনকে খুঁজে পেয়েছি। সবাই মৃত।’
পাকিস্তানি সেনাদের এই অভিযানে সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয় পুরান ঢাকার হিন্দু এলাকায়। সৈন্যরা সেখানকার বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের করে এনে দলবেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। তারপর জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। রাত ১১টা পর্যন্ত সৈন্যরা পুরান ঢাকায় অবস্থান করে। সৈন্যরা ফ্লেয়ার ছুড়লে বাঙালি ইনফরমাররা আওয়ামী লীগের শক্ত সমর্থকদের বাড়ি দেখিয়ে দিত, তারপর সৈন্যরা ট্যাংকের গোলায়, রিকয়েললেস রাইফেলের গুলিতে অথবা পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে এসব বাড়ি ধ্বংস করে দিত।
শহর এলাকায় রোববার সকাল পর্যন্ত গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। তবে বড় ধরনের অভিযানগুলো ২৬ তারিখ রাতের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সময় লাগে শুরু হওয়ার পর থেকে ঠিক ২৪ ঘণ্টা।
সৈন্যদের শেষ টার্গেটগুলোর একটি ছিল বাংলা দৈনিক ইত্তেফাক-এর অফিস। পাকিস্তানি সেনাদের হামলা শুরুর সময় ওখানে ৪০০ সৈন্য আশ্রয় নেয়। ২৬ মার্চ বিকেল চারটা নাগাদ চারটি ট্যাংক এসে দাঁড়ায় ইত্তেফাক ভবনসংলগ্ন রাস্তায়। আর সাড়ে চারটায় ওই ভবনটি পরিণত হয় অগ্নিপিণ্ডে। শনিবার সকালে ওই ভবনে কয়লা হয়ে যাওয়া মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
যত দ্রুত সৈন্যরা শহরের রাস্তায় অবস্থান নিয়েছিল, ঠিক ততটা দ্রুতই তারা সরে যায়। শনিবার সকালে রেডিওতে সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কারফিউ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। রেডিওর ঘোষণায় সামরিক আইনের বিধানগুলো বারবার বলা হতে থাকে: রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগ দিতে বলা হয় এবং ব্যক্তিগত অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ঈষৎ সংক্ষেপিত