টিসিবির পণ্য কিনতে মধ্যবিত্তরাও আসছেন

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি
ছবি: প্রথম আলো

সরকারি হিসাবে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। গরিব মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের পকেটেও টান পড়েছে এখন। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সরকারি সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ন্যায্য নিত্যপণ্য বিক্রির জন্য তৈরি করা হয়েছে ফ্যামিলি কার্ড। দ্রব্যমূল্য, আসন্ন পবিত্র রমজান, ক্রেতাদের বেশি কেনা ও একশ্রেণির ব্যবসায়ীর অতি মুনাফা করার প্রবণতাসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গত মঙ্গলবার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ফখরুল ইসলাম

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: টিসিবির ট্রাক এবং ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে এক কোটি পরিবারের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে কয়েকটি নিত্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এমন পদক্ষেপ কেন নিলেন?

টিপু মুনশি: জিনিসপত্রের দাম যে বেড়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সারা বিশ্বেই তা বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালেও বিষয়টি বোঝা যায়। তবে আমাদের তো আর বসে থাকলে চলবে না। আমরা একটা বিষয় ভেবেছি। সেটা হচ্ছে দেশে দরিদ্র ও হতদরিদ্র মিলিয়ে তিন থেকে সোয়া তিন কোটি মানুষ আছেন। একটি পরিবারে চারজন করে ধরে আমরা এক কোটি পরিবার অর্থাৎ চার কোটি মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, চিনি ইত্যাদি পণ্য বিক্রির আয়োজন করেছি। ২০ মার্চ থেকে দেশব্যাপী এ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। তবে এখানে দরিদ্রদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও পণ্য কিনতে আসছেন।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নিত্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম। ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি কি আরেকটু আগে নেওয়া যেত?

টিপু মুনশি: নিশ্চয়ই যেত। সেটা ভালো হতো। আমরা তো চাপ দিয়ে আসছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে নির্দেশনা আসার পর প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভোজ্যতেলের ভ্যাট নিয়ে দুই দিনের ব্যবধানে দুই দফা প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। এটা নিশ্চয়ই সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার লক্ষণ।

টিপু মুনশি: ভ্যাট প্রত্যাহারের কাজটা এগোচ্ছিল। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মাঝখানে একটা ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এরপর এনবিআর যখন ১৪ মার্চ প্রথম প্রজ্ঞাপন জারি করল, আমরা বললাম এটা হবে না। এই ফাঁকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাটিও এল। পরে আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি হলো। খুচরা পর্যায়ে লিটারে সয়াবিন তেলের দাম এখন ৭ থেকে ৮ টাকা কমল। এর ফলে দাম আরও বৃদ্ধির প্রবণতা কমে গেল। আমাদের ধারণা, ব্যবসায়ীরাও এখন রক্ষণশীল থাকবেন। দাম বৃদ্ধি করার জন্য অন্তত মজুত করে রাখার চিন্তা করবেন না তাঁরা।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারে সঙ্গে সঙ্গেই দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কমলে আর দেশীয় বাজারে কমাতে চান না। বিষয়টি তদারকির বাইরে থেকে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নেই?

টিপু মুনশি: এটা ঠিকই বলেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারের ধুয়া তুলে একশ্রেণির ব্যবসায়ী তা করেন। এখন অবশ্য খুব একটা সুযোগ নেই। প্রায় সব তথ্যই জানা সম্ভব। মূল্য সংযোজন, মুনাফা, পরিবহন খরচ ইত্যাদি হিসাব করে কিছু নিত্যপণ্যের দামের অঙ্ক কষা হয় সব সময়। ফলে এগুলো আমাদের তদারকির বাইরে থেকে যাওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পেঁয়াজ নিয়ে প্রতিবছরই সংকট হয়। ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিলে সংকট হয় তীব্রতর, দামও বেড়ে যায়। বিকল্প উৎসের কথা ভাবার সময় আসেনি এখনো?

টিপু মুনশি: পেঁয়াজের অবস্থার কিছুটা উত্তরণ ঘটছে। নতুন বীজ দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। বীজটা এমন সময়ে রোপণ করতে হবে, যাতে সংকটের সময় আমরা ফলনটা পাই। আগামী এক থেকে দুই বছরে পেঁয়াজের সংকট ও দামের বিষয়ে অন্তত ৯৫ শতাংশ সমাধান হয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি।

মেয়ে মাইশাকে স্কুলে দিয়ে টিসিবির পণ্য নিতে লাইনে দাঁড়ান সোহাগী আক্তার। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও পণ্য পাননি। পরে স্কুলে গিয়ে মেয়েকে নিয়ে এসে আবার লাইনে দাঁড়ান তিনি। পরে পণ্য নিয়ে বাড়ি ফেরেন মা–মেয়ে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর বাড্ডা জাগরণী সংঘ মাঠে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আবার টিসিবির প্রসঙ্গে আসি। পণ্য দিতে না পেরে টিসিবির ট্রাক চলে যাচ্ছে, আর মানুষ পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। এমন দৃশ্যকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

টিপু মুনশি: এটা হয়েছে। আসলে একেকটি ট্রাক ২৫০ জনকে পণ্য দিতে পারে। ৩০০ জন মানুষ লাইনে থাকলেই তো ৫০ জন বঞ্চিত হলেন। ২৫০ জন যে সাশ্রয়ী দামে পণ্য পেলেন, সেটাও একটু লিখুন। ৫০ জন যে পেলেন না, শুধু সেটাই লিখবেন কেন? আবার এমন দৃশ্যও কিন্তু আছে যে ট্রাক পণ্য নিয়ে বসে আছে, কিন্তু কেনার লোক নেই। পুরান ঢাকাতেই এমন ঘটনা ঘটেছে। পণ্য বিক্রি শেষ করতে রাত ১০টা পর্যন্ত সময় লেগেছে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দুই ধাপে এক কোটি মানুষের কাছে পণ্য বিক্রির যে তালিকা করা হয়েছে, তা কীভাবে করা হয়েছে? তালিকা তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগ আছে।

টিপু মুনশি: নগদ এককালীন আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার জন্য ২০২০ সালে যে তালিকা করা হয়েছিল, তা থেকে ৩০ লাখ পরিবারকে নেওয়া হয়েছে। নতুন করে যোগ করা হয়েছে ৫৭ লাখ পরিবারের তালিকা। সবাইকে ফ্যামিলি কার্ড দেওয়া হয়েছে। আগের তালিকা যে প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে, পরেরটিও সেভাবে হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে ফ্যামিলি কার্ড তৈরিতে কোথাও কোথাও একটু অনিয়ম হতে পারে।

দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ন্যায্যমূল্যে টিসিবির পণ্য কিনতে ভিড় করছেন মানুষেরা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সামনে পবিত্র রমজান। সারা পৃথিবীতেই বড় বড় উৎসব উপলক্ষে পণ্যের দামে ছাড় দেওয়া হয়। ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বরং উৎসবের সময় দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে?

টিপু মুনশি: এটা একটা সত্য কথা বললেন। অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফাপ্রবণতার কারণে এটা হয়। পবিত্র রমজান হচ্ছে সংযমের মাস। কোথায় রমজানে আরেকটু বেশি সংযমী হবেন, তার পরিবর্তে একশ্রেণির ব্যবসায়ী আরও বেশি মুনাফা করার জন্য যেন রমজানকেই বেছে নেন। এ মানসিকতা বদলাতে হবে। বদলানো একটু কঠিন। তবে বদলানো উচিত। অন্য দিক থেকে ক্রেতাদের মানসিকতাও বদলাতে হবে। তাঁরা একসঙ্গে বেশি পরিমাণে পণ্য কিনতে চান। এতে বাজার অস্থির হয়ে পড়ে এবং পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বাজারে কোনো সিন্ডিকেট আছে বলে মনে করেন? তারা কারা?

টিপু মুনশি: বড় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আছে। তারা সিন্ডিকেট করতে পারে। আমরা চাই ছোট বা মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাও ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় আসুক। প্রয়োজনে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থাসহ বিশেষ সহযোগিতা দেওয়া হবে তাদের।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: রাশিয়া–ইউক্রেন পরিস্থিতির কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাজারে?

টিপু মুনশি: কিছুটা তো পড়েছেই। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দামে। জ্বালানি তেলের সঙ্গে তো অনেক কিছুই সম্পর্কিত।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভোগ্যপণ্যে আমদানিনির্ভরতা কমানোর কোনো পরিকল্পনা আছে?

টিপু মুনশি: কিছু পণ্য আছে, আমদানি করতেই হবে। এ দেশের মাটিতে যেমন ভোজ্যতেল খুব বেশি উৎপাদন হবে না। অন্তত ২০ শতাংশ যাতে দেশেই উৎপাদন করা যায়, সেভাবে আমরা এগোচ্ছি। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এরই মধ্যে ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির কিছু পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন। আমরা আশাবাদী।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

টিপু মুনশি: আপনাকেও ধন্যবাদ।