টিকা গ্রহণকারীর তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়নি

টিকা কে পাবেন কে পাবেন না, তা এখন আলোচনার বিষয়। এ ব্যাপারে স্বচ্ছতা দরকার। মানুষের মধ্যে যেন বঞ্চনা বোধ না থাকে।

করোনার টিকা
রয়টার্সের ফাইল ছবি

করোনার টিকা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন শ্রেণি-পেশার মানুষ পাবেন, তা প্রায় চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে টিকাগ্রহীতার তালিকা কীভাবে তৈরি হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) সঙ্গে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশে করোনার টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে জানুয়ারির শেষ দিকে বা ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে করোনার টিকা আনা হবে, এমন কথা বলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বাংলাদেশ সরকারিভাবে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা আনার উদ্যোগ নিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যোগ্য ব্যক্তির টিকা পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য দেশের যেকোনো একটি উপজেলায় দিশারি প্রকল্পের মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে দ্রুত ভুল-ত্রুটি শনাক্ত করা দরকার।

কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও ব্যবহার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরিকল্পনায় সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী, জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় পেশাজীবী, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎকর্মী, বন্দরকর্মী, বয়স্ক ও দীর্ঘস্থায়ী রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে প্রথম পর্যায়ে টিকা দেওয়ার কথা বলা আছে। এসব শ্রেণি-পেশার মানুষের তালিকা তৈরিতে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্টের সহায়তা নেওয়া হবে।

টিকার বিষয়ে গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সভা হয়। সভায় উপস্থিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তালিকা তৈরিতে একাধিক অ্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ব্যয়বহুল নয় এমন অ্যাপ ব্যবহারের কথা ভাবছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এ ব্যাপারে কোভিড ১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি কমিটির প্রধান এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, কীভাবে তালিকা তৈরি হবে, তা নিয়ে সরকারের আইসিটি বিভাগের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আইসিটি বিভাগ একটি অ্যাপ তৈরি করে দেবে।

প্রাথমিক উদ্যোগে অসংগতি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচি (এমএনঅ্যান্ডসিএইচ) দেশব্যাপী টিকা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে। এমএনঅ্যান্ডসিএইচ কার্যালয় জেলা পর্যায়ে করোনা টিকার চাহিদা জানার উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা ২৭ অক্টোবর সারা দেশের সিভিল সার্জনদের কাছে চিঠি পাঠায়। তাতে জেলার সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং সাংবাদিকদের সংখ্যা পাঠাতে বলা হয়।

কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও ব্যবহার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরিকল্পনায় সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী, জনপ্রতিনিধি, ধর্মীয় পেশাজীবী, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎকর্মী, বন্দরকর্মী, বয়স্ক ও দীর্ঘস্থায়ী রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে প্রথম পর্যায়ে টিকা দেওয়ার কথা বলা আছে। এসব শ্রেণি-পেশার মানুষের তালিকা তৈরিতে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্টের সহায়তা নেওয়া হবে।

ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা—এই পাঁচটি জেলার সিভিল সার্জনদের পাঠানো তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। ফরিদপুর জেলার সিভিল সার্জনের পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, ফরিদপুর জেলায় পৌরসভাগুলোতে কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১৬। ফরিদপুর জেলায় পৌরসভা আছে ৬টি। এসব পৌরসভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় শ। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফরিদপুরের সিভিল সার্জন মো. ছিদ্দীকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে তথ্য পাঠিয়েছি, তা অকেজো (ইনভেলিড)। ওই তথ্য ব্যবহার করা যাবে না।’

এটা শুধু ফরিদপুর জেলার ক্ষেত্রে ঘটেনি। অনির্ভরযোগ্য ও অসম্পূর্ণ হওয়ার কারণে বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো তথ্য ব্যবহার করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে এমএনঅ্যান্ডসিএইচের লাইন ডিরেক্টর শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, টিকাগ্রহীতার সংখ্যা জানার উদ্যোগ তাঁরা বাতিল করেছেন। তিনি বলেন, ‘তালিকা তৈরি করাকে আমরা চ্যালেঞ্জ মনে করছি না। তবে এক নম্বর কাজ হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছি।’

দ্রুত তালিকা দরকার

টিকা কবে আসবে, সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। তবে টিকা এলে সরকার সবাইকে একসঙ্গে টিকা দিতেও পারবে না। সে কারণে তালিকা তৈরি হওয়া দরকার। তালিকা তৈরি হলে কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা পেতে যাচ্ছেন, তা অনেকটাই পরিষ্কার হবে।

এরই মধ্যে মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন-উদ্বেগ-সন্দেহ তৈরি হতে শুরু করেছে। রোববার এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ আয়োজিত ‘কোভিড-১৯ টিকা বাংলাদেশে কে কখন কীভাবে পাবে’ভার্চুয়াল সংলাপে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলেছেন, টিকা গ্রহীতার তালিকা তৈরি ও টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। তথ্যভান্ডার তৈরি করতে হবে এবং তা প্রকাশ করতে হবে।

টিকার জন্য সারা দেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। জেলা পর্যায়ে কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। একাধিক জেলা প্রশাসক প্রথম আলোকে বলেছেন, ওপর থেকে তালিকা তৈরির নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, টিকা না পাওয়া ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হতে পারেন। কে টিকা পাবেন, কে পাবেন না তার বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরলে ব্যক্তির মধ্যে বঞ্চনা বোধ তৈরি হবে না, মানুষ ক্ষুব্ধ হবে না। তিনি বলেন, টিকাগ্রহীতার তথ্য সংগ্রহের সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করতে হবে এবং মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।