ঝড়ের পাখি ও তাঁর মুক্তির গান

আলতাফ মাহমুদ

মাত্র ৩৮ বছরের এক জীবনে আলতাফ মাহমুদ (১৯৩৩-৭১) যেন বহু জীবনের কাজ করেছেন। জন্মস্থান বরিশালে। জীবনের প্রথম ১৭ বছরে শিক্ষালাভের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছেন গণসংস্কৃতিচর্চায়। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে পরবর্তী দুই দশক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও সাম্যবাদী আদর্শের সাংস্কৃতিক জগতে এক অনিবার্য মুখ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মোশাররফ উদ্দীন রচিত ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে’ (১৯৫২) এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কালজয়ী ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ (১৯৫৩) গানের সুরকার হিসেবেই তিনি অমর হয়ে থাকতে পারতেন। আশ্চর্যের বিষয়, এ দুটো গানে তিনি সুরারোপ সম্পন্ন করেছেন ২০ বছর বয়সসীমার মধ্যেই।

মতিউর রহমানের ভাষায় আলতাফ মাহমুদ সেই ‘ঝড়ের পাখি’, যিনি কখনো থেমে থাকতে জানতেন না। কণ্ঠে মুক্তির গান নিয়ে তিনি উড়ে বেড়াতে চেয়েছেন মানুষের জন্য স্বাধীনতার উদার আকাশে। তাই গানে সুরারোপের সমান্তরালে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ছায়ানাট্য, চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা কিংবা কণ্ঠদান যেমন করেছেন, তেমনি ভূমিকা রেখেছেন পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলার পথে-প্রান্তরে সাংস্কৃতিক সম্মেলনে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে রাজপথে নেমেছেন, সত্তরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পর গান গেয়ে দাঁড়িয়েছেন বিপন্ন মানুষের পাশে। একই সঙ্গে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে ঢাকা ক্র্যাক প্লাটুনের সঙ্গে যুক্ত থাকার পাশাপাশি গান রেকর্ড করে পাঠিয়েছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।

আলতাফ মাহমুদকে চিনতে ভুল হয়নি পাকিস্তানি হানাদারদের; একাত্তরের ৩০ আগস্ট ঢাকার বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় তারা। নির্মম নির্যাতনের পর বাংলার এই সুর-সেনানী শহীদ হন স্বদেশের স্বাধীনতার বেদিমূলে।


২. আলতাফ মাহমুদের অন্তর্ধানের ৫০ বছর এবং মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মতিউর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো আলতাফ মাহমুদ: এক ঝড়ের পাখি (প্রথমা প্রকাশন, আগস্ট ২০২১)। ‘আপনজনদের চোখে’ এবং ‘বন্ধু ও সহকর্মীর কলমে’—এই দুই ভাগে ১৪টি লেখা সংকলিত হয়েছে এখানে। কাইয়ুম চৌধুরী অঙ্কিত প্রতিকৃতির পাশাপাশি এ বইয়ে আছে আলতাফ মাহমুদের বেশ কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র।

ব্যক্তি আলতাফ মাহমুদের একান্ত প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে সহধর্মিণী সারা আরা মাহমুদের ‘অমর সংগীতের মহান সুর’ লেখাটিতে:

‘১৯৬৩ সালে ঢাকার কোনো এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। সে সময় সংগীতই তাঁর একমাত্র নেশা ও পেশা। কণ্ঠে তাঁর উদ্দাম সুর। তাঁর গান শ্রোতাকে কখনো আনন্দিত, কখনো বেদনার্ত, কখনোবা উদ্দীপ্ত করত। আলতাফ মাহমুদ তখন সবার প্রিয় নাম। সে নাম একসময় আমাকে স্পর্শ করল। আমি তাঁকে চিনলাম, জানলাম।’

৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড, রাজারবাগের বাড়িটি, যেখানে মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ স্বেচ্ছায় সঞ্চিত রেখেছিলেন অসমসাহসী আলতাফ মাহমুদ। সে গোলাবারুদের সন্ধানে পাকিস্তানি সেনারা বাড়িতে এসে মুক্তিসংগ্রামের বারুদদীপ্ত মানুষ আলতাফ মাহমুদকেও ধরে নিয়ে যায়। অন্য সঙ্গীরা ফিরে এলেও আলতাফ আসেননি আর। শ্যালক ও সহযোদ্ধা দিনু বিল্লাহর শোকস্তব্ধ উচ্চারণ:

‘এখনো আমার আদরের বোনটি ওই মানুষটির জন্য অপেক্ষা করছেন—হয়তো আজীবন অপেক্ষা করবেন। আলতুর শোকে কিছুদিন পর আমার মা পক্ষাঘাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আর তিন বছরের শাওন কোনো দিন বাবা বলতে পারল না।’

শিল্পী আবুল বারক আলভী ‘আলতাফ ভাইয়ের সঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর ৩৬ ঘণ্টা’ শিরোনামের বিষাদ-ভারাতুর লেখায় ৫০ বছর আগে আলতাফ মাহমুদসহ তাঁদের ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর তৎপরতার বিশদ বিবরণদানের পাশাপাশি আলতাফ মাহমুদকে পাকিস্তানি হানাদারদের শনাক্ত করা এবং নির্মম নির্যাতনের গা শিউরে ওঠা বর্ণনা দিয়েছেন:

‘ওরা আসলে আলতাফ ভাইয়ের খোঁজেই এসেছিল। আলতাফ ভাইয়ের শ্যালকেরা ও আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সবার দিকে তাকিয়ে একজন বলল, মিউজিক ডিরেক্টর সাব কৌন হ্যায়?

আলতাফ ভাই এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমি।

...

তো, রান্নাঘরের পেছনে একটা জায়গা ছিল, ওখানেই মাটি খুঁড়ে রাখা ছিল অস্ত্রগুলো। পরিচয় পেয়ে আর্মির লোকজন আলতাফ ভাইকে মারতে মারতে নিয়ে যায় রান্নাঘরের পেছনে ওই জায়গাটায়। তাঁকেই মাটি খুঁড়তে বলা হয়েছিল। সে সময়ও বারবার আঘাত করা হয়। লাথি মারা হচ্ছিল, রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করা হচ্ছিল।’

৩. প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী শেখ লুতফর রহমানের স্মৃতিচারণা যেন আজকের প্রজন্মের কাছেও হাজির করে অর্ধশতাব্দী আগে হারিয়ে যাওয়া সেই সুরসৈনিককে:

‘যতটুকু মনে পড়ে “ক্রান্তি”র ব্যবস্থাপনায় আমিনুল হকের পরিচালনায় পল্টনে নৃত্যনাট্য জ্বলছে আগুন ক্ষেতখামারে করা হয়েছিল। সেদিন আলতাফ “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি” গানটা গেয়েছিল। ওর গলায় “ও বাঙালি” টানটা আজও আমায় কাঁদায়।’

সংস্কৃতি-সাধক ওয়াহিদুল হক আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত একুশের গানের তাৎপর্য আবিষ্কার করেন এভাবে:

‘বাঙালি যত দিন থাকবে এই ধরাপৃষ্ঠে, থাকবে “আমার সোনার বাংলা”, থাকবে “বাংলার মাটি, বাংলার জল”, আর থাকবে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো”।’

কামাল লোহানীর ‘কমরেড আলতাফ মাহমুদ’ লেখায় অস্ত্র ও সুরের শাণিত যোদ্ধা আলতাফ মাহমুদের স্বরূপের সন্ধান মেলে, ‘হারমোনিয়ামের রিড যে হাতে বাজত, সে হাতেই উঠেছিল মলোটভ ককটেল, গ্রেনেড, এলএমজি, এসএমজির ট্রাংক...।’

আনিসুজ্জামান, নিজামুল হক, হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ, নূরুল হক বাচ্চু, মাহমুদ আল জামান এবং শিমূল ইউসুফের লেখাতেও পাওয়া যাবে বিচিত্র-বর্ণিল-ব্যতিক্রম আলতাফ মাহমুদকে।

৪. বইয়ের সম্পাদক মতিউর রহমানের ‘ঝড়ের পাখির অসমাপ্ত গান’ লেখার অন্তিমাংশেই যেন বিধৃত আছে আলতাফ মাহমুদের প্রতি তাঁর রক্তে ভেজা বাংলাদেশের বিনীত শ্রদ্ধার্ঘ্য:

‘আলতাফ ভাই—আলতাফ মাহমুদ ছিলেন আমৃত্যু সংগ্রামী, লড়াইয়ের মাঠেই তাঁর মৃত্যু হলো। বর্বর পাকিস্তানি অত্যাচারী সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যা করেই শুধু তাঁর কণ্ঠ রোধ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু “বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত”—ঝড়ের পাখির অসমাপ্ত গানের কণ্ঠস্বর আজও বাজে আমাদের বুকের ভেতর। আজও তাঁর সুরে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গান গেয়ে হাজার-লক্ষ মানুষ মিছিল করে বাংলাদেশের সর্বত্র।’

এই অনন্য বইয়ে প্রিয়জনদের স্মৃতি আছে, বেদনা আছে। ব্যক্তি আলতাফ মাহমুদের সূত্রে আছে বাংলাদেশের সংগ্রামী সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিশ্বস্ত বিবরণ। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের অসাধারণ অবদানের কথা জানতে হলে বইটি জরুরি সূত্র হিসেবে কাজ করবে। বইটি মৃত্যুঞ্জয়ী আলতাফ মাহমুদকে তাঁর উত্তরপ্রজন্মের কাছে নতুন করে উদ্ভাসিত করবে।

আলতাফ মাহমুদ অমর। একুশ ও একাত্তরময় বাংলাদেশে আলতাফ মাহমুদের কি মৃত্যু হতে পারে?