জীবনে একবার হলেও হজ পালন করি
সৌদির বাদশাহর উদ্যোগে একবার বাংলাদেশের ৫০ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পবিত্র ওমরাহ পালন ও মক্কা-মদিনা জিয়ারতসহ দর্শনীয় স্থান প্রদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিচারপতি, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা। ওই দলের সঙ্গে রাজকীয় অতিথি হিসেবে ওমরাহ পালনের সুযোগ আমার হয়েছিল। ২০১৫ সালের ২০ মে বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় আমরা সেখানে পৌঁছাই। ১০ দিনের সফর শেষে ৩০ মে দেশে ফিরে আসি।
দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার পর সৌদি আরব বাংলাভাষীদের জন্য পবিত্র কোরআনের অনুবাদ প্রকাশ করে। আগে কিং ফাহাদ প্রিন্টিং কমপ্লেক্সে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান অনূদিত তাফসিরে মারেফুল কোরআনের প্রায় ১০ লাখ কপি বিনা মূল্যে বিতরণ করেছিল সৌদি সরকার। দীর্ঘদিন পর আবারও সৌদি সরকার কর্তৃক বিনা মূল্যে পবিত্র কোরআন বিতরণের এই প্রকল্প চালু করায় বাংলাভাষীদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ দেখা দিয়েছে। সফরের অংশ হিসেবে আমরা মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ আলেম ও মসজিদে নববির খতিব আলী আবদুর রহমান হোজাইফির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করি।
এ ছাড়া আমি কয়েকবার স্ত্রীসহ হজ ও ওমরাহ পালন করেছি। এ জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই।
উচ্চ স্বরে ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ পাঠ করতে করতে পৌঁছেছিলাম সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে। সেখানে গিয়ে হোটেলে লাগেজ রেখেই ছুটে চললাম মসজিদুল হারামে। হজের আগে ওমরাহ করে নেওয়া উদ্দেশ্য। মসজিদের ১ নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখের সামনে চলে এল কাবাঘর। মনে মনে দোয়া করছি আল্লাহর দরবারে।
ওমরাহর অংশ হিসেবে মাতাফে গিয়ে হাজরে আসওয়াদকে বাঁ দিকে রেখে তাওয়াফ শুরু করলাম। সাত পাক ঘুরে একটি তাওয়াফ সম্পন্ন করলাম। প্রতি পাকের শুরুতে ও শেষে দোয়া পড়েছি। মনে রাখার সুবিধার্থে আমি একটি সহজ দোয়া পড়েছিলাম, যার বাংলা রূপ হচ্ছে, ‘আল্লাহ পবিত্র এবং সকল প্রশংসা আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আল্লাহ মহান। আল্লাহ একমাত্র শক্তিশালী, যিনি মহান ও পবিত্র। দরুদ ও সালাম মহানবী (সা.)-এর জন্য।’
সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিল, তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ পাথরে চুমু খাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইব্রাহিমের কাছে নামাজ আদায় করে আল্লাহর দরবারে কেঁদেছিলাম। ওমরাহর রীতি অনুসারে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে দোয়া করলাম, তারপর কাবার দরজা ও গিলাফ ধরে দোয়া করলাম। তারপর জমজমের পানি খেয়ে গেলাম সাফা-মারওয়া পাহাড়ের উদ্দেশে। সেখানেও নিয়ম অনুযায়ী দুই পাহাড়ে সাতটি দৌড় দিলাম। সবশেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে মাথা ন্যাড়া করে ওমরাহ আনুষ্ঠানিকতা শেষ করলাম।
৮ জিলহজ হজের ইহরাম বেঁধে মিনার উদ্দেশে রওনা দিই। জোহরের নামাজের আগেই মিনায় পৌঁছানোর নিয়ম। সেভাবেই আমি রওনা দিয়েছিলাম এবং মিনায় পৌঁছে ওই দিনের জোহর থেকে পরবর্তী দিনের (৯ জিলহজ) ফজর পর্যন্ত মোট পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছিলাম। নামাজের পরপরই আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হই। আরাফাতে অবস্থান ফরজ। দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হবে। আরাফাতের ময়দানে তাঁবুর ভেতরে ওয়াক্তমতো জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করে সূর্যাস্তের পরে মুজদালিফায় রওনা দিলাম। সেখানে নিয়ম অনুসারে এক আজান ও দুই একামতের সঙ্গে মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে পড়লাম। মুজদালিফায় বালুর ওপরে চাদর বিছিয়ে রাতযাপনের করার অভিজ্ঞতা সত্যিই মনে রাখার মতো। রাতযাপনের সুবিধার্থে আমি একটি হালকা লাগেজ সঙ্গে রেখেছিলাম। কঙ্কর নিক্ষেপের প্রস্তুতি হিসেবে মুজদালিফায় থাকাকালে ৭০টি ছোট কঙ্কর সংগ্রহ করে আমার ব্যাগে রেখেছিলাম।
১০ জিলহজ ফজরের নামাজ পড়ে সূর্য উদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশে রওনা দিলাম। মিনায় এসে তাঁবুতে লাগেজ রেখে বড় শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সাতটি পাথর নিক্ষেপ করলাম। যথারীতি পাথর নিক্ষেপ করে মিনায় ফিরে এলাম। এবার আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি করার পালা। কোরবানির উদ্দেশ্যে ব্যাংকে প্রয়োজনীয় টাকা জমা দিলাম। কোরবানি সম্পন্ন হয়ে গেলে মাথা ন্যাড়া করে গোসল সেরে ইহরাম খুলে ফেললাম। ওই দিনই মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে জিয়ারত সম্পন্ন করেছিলাম। মক্কায় কাবাঘরে গিয়ে তাওয়াফে জিয়ারত করা ফরজ। এটার পদ্ধতি আগের তাওয়াফের মতোই। তাওয়াফ শেষে পুনরায় সাফা-মারওয়া সাঈ করা ওয়াজিব। নিয়মানুসারে তাওয়াফ সাঈ শেষে মিনায় গিয়ে রাত যাপন করেছিলাম।
১১ জিলহজ দুপুরের পর থেকে পর্যায়ক্রমে ছোট, মধ্যম ও বড় শয়তানকে ৭টি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করেছিলাম। পরদিন, অর্থাৎ ১২ জিলহজও আগের দিনের মতো ২১টি পাথর নিক্ষেপ করেছিলাম।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হজযাত্রীদের হজ শেষে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয়। আমি বিদায়ী তাওয়াফ করে মদিনার উদ্দেশে রওনা দিলাম।
মদিনায় এসে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা জিয়ারত করলাম। সে এক আবেগঘন স্মৃতি। আমি মদিনা শরিফে ৮ দিন অবস্থান করে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছিলাম আর জান্নাতুল বাকি, জাবালে ওহুদ, মসজিদে কুবাসহ মুসলিম ঐতিহ্যের উল্লেখযোগ্য সব নিদর্শন পরিদর্শন করেছিলাম।
মদিনা শরিফ জিয়ারতের পর আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও তাঁর দ্বীনের প্রতি বর্ধিত প্রেম নিয়ে জেদ্দা হয়ে স্বদেশে ফিরে এলাম। জীবনে একবার হলেও হজ পালন করি।
লেখক: এক্সিম ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)