প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি। এ নিয়ে রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি বলেছে, এর মাধ্যমে সরকার বড় ধরনের সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছে। আর সরকারি দলের নেতারা বলেছেন, ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা ঠেকাতে এবং উচ্চ আদালতের রায় কার্যকর করতে এটা করা হয়েছে।
জাতীয় পুরস্কার-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গত বুধবার জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রত্যাহারের পাশাপাশি জাতীয় জাদুঘর থেকে ওই পুরস্কারের মেডেল ও সম্মাননাপত্র সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র কমিটির এই সিদ্ধান্তের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
কমিটির একাধিক সদস্য বিষয়টি স্বীকার করলেও প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তাঁরা বলেছেন, একই সঙ্গে দুজনকে স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে জিয়াউর রহমানকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছাকাছি নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এ জন্য কমিটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রিসভা কমিটি মনগড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এটা উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে নিতে হয়েছে। বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছিল, মানবতাবিরোধীদের রক্ষা করেছিল। দলটির নেতারা পদে পদে প্রমাণ করেছেন যে, তাঁরা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নন।
>* সরকার বলছে, ইতিহাস বিকৃতি ঠেকানোই উদ্দেশ্য
* এটা সংকীর্ণতার পরিচয় বলে বিএনপির মত
মন্ত্রিসভা কমিটি মনে করে, এই পুরস্কার যদি জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে আগামী প্রজন্মের কাছে ভুল ইতিহাস উপস্থাপিত হবে এবং একটি ভুল বার্তা যাবে। জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত এটা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত কোনো চিঠি পায়নি। তবে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পুরস্কারের পদক ও সম্মাননা কোথায়, কীভাবে রাখা আছে, সে-সম্পর্কিত তথ্য নেওয়া হয়েছে জাদুঘরের কাছ থেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাদুঘরের একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি একটি চিঠির জবাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানানো হয়েছে, বঙ্গভবনের তোশাখানা থেকে পুরস্কারটি জাতীয় জাদুঘরে এসেছিল। এটি জাদুঘরের গুদামে সংরক্ষিত আছে। এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা জানান, জাদুঘরে প্রায় ৯৫ হাজার নিদর্শন আছে। এর মধ্যে সাড়ে চার হাজার প্রদর্শন করা যায়, বাকি নিদর্শন গুদামে থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিসভা কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, এটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত। এখানে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নেই।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারও তুলনা হয় না। জিয়াউর রহমান নিজেও যে দাবি করেননি, সেই দাবি তুলে তাঁকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও জনকের কাছাকাছি নেওয়ার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ তখনই আপত্তি তুলেছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত কোনো রাজনৈতিক ব্যাপার নয়, এটা নীতি ও ইতিহাসের প্রশ্ন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত পরিস্থিতির মধ্যে এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে বিস্মিত হয়েছি। এটা রুচিশীল ও গ্রহণযোগ্য কাজ নয়। বঙ্গবন্ধুকন্যার মাধ্যমে এই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শুনতে ভালো লাগছে না।’ তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধুর নামে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তিনি একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তাঁকে বীর উত্তম উপাধি দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকার। স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার জন্য এগুলো কি যথেষ্ট নয়?
২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। সে সময় পুরস্কারের মেডেল, সম্মাননাপত্র কোনো উত্তরাধিকারকে না দিয়ে জাতীয় জাদুঘরের একটি কর্নারে যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জিয়াউর রহমানকে পুরস্কার দেওয়ায় আপত্তি তোলে দলটি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানায়, মন্ত্রিসভা কমিটির গত বুধবারের সুপারিশ ও সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। তিনি অনুমোদন দিলে বিষয়টি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।
গত ২৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো নথিতে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতি পদ বা রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণের বিষয়টি হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন। নথিতে স্বাধীনতা পুরস্কার-সংক্রান্ত সংশোধিত নির্দেশমালা উল্লেখ করে বলা হয়, স্বাধীনতা পুরস্কার দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। তাই এই পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রার্থী নির্বাচনকালে দেশ ও মানুষের কল্যাণে অসাধারণ অবদান রেখেছেন এমন সীমিত সংখ্যক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেই বিবেচনা করা হবে।
মন্ত্রিসভা কমিটি সূত্র জানায়, জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণকে উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আমলে নিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি। এ ছাড়া কমিটি মনে করে, স্বাধীনতা পুরস্কার-সংক্রান্ত ২০১৬ সাল পর্যন্ত সংশোধিত নির্দেশনাবলির সঙ্গে ২০০৩ সালের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্তটি সাংঘর্ষিক।
প্রসঙ্গত, এর আগে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে সরকার। এ লক্ষ্যে আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছিল গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এ নিয়েও বিএনপি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল।
বিএনপির সংবাদ সম্মেলন: জিয়াউর রহমানকে দেওয়া ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রত্যাহারে সরকারের মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্তে উদ্বেগ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছে বিএনপি। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সম্পূর্ণ বৈধভাবে নির্বাচিত একটি সরকারের দেওয়া এই স্বাধীনতা পদক বর্তমান বিতর্কিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা কমিটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ফখরুল বলেন, জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে দেশে প্রথম স্বাধীনতা ও একুশে পদক প্রবর্তন করেন। যিনি পদক প্রবর্তন করলেন, তিনি বাদ। কিন্তু পদক থাকবে, তাঁর কীর্তিও থাকবে। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের সরকারই তাঁকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করে তাঁর অবদানের জন্য। তিনি বলেন, এ সরকার ঐক্যের রাজনীতিকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে গোটা জাতিকে বিভাজনের রাজনীতিতে নিয়ে এসে বিভক্ত করে দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও নজরুল ইসলাম খান।