পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকা সফরে আসেন। এ সফর পূর্বনির্ধারিত হলেও আমাদের বিশ্বাস, এর উদ্দেশ্য ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের জনসাধারণকে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎদান এবং সেই সঙ্গে তাঁর বিশাল জনপ্রিয়তার চাপে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি নস্যাৎ করা। কারণ, তখনো এ দেশের মানুষ ‘কায়েদে আজম’ বলতে আবেগে অন্ধ।
রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি যে তাঁর মনে প্রচণ্ড সমস্যা হয়ে ধরা ছিল, এর প্রমাণ তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায় উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে জবরদস্ত মতামত পূর্ববঙ্গবাসীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া। এমনকি সেই সূত্রে সমস্যাজর্জরিত পূর্ববঙ্গে সংঘটিত আন্দোলন, বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ—সবকিছুই রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ হিসেবে চিহ্নিত করা। তাঁর অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার কথা জানা ছিল বলেই পূর্ববঙ্গবাসীর যুক্তিসংগত প্রতিবাদের ওপর পাথর চাপা দিয়ে তিনি ঢাকা সফর শেষ করেন।
পূর্ববাংলার মাটিতে পা রেখে পাকিস্তানের এই স্থপতি তিনটি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেন। যেমন ঢাকায় রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রে, তেমনি কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এবং পাকিস্তান বেতারে—প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি একই সুরে কথা বলেন। এসব বক্তৃতায় মূল কথা ছিল: পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উদুর্, কমিউনিস্ট ও বিদেশি চরদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল এবং দলে দলে মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে জাতির খেদমতে আত্মনিয়োগ করা। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রবিরোধীদের তিনি কঠোর হাতে দমন করবেন। সরকারের সমালোচনা তাঁর চোখে হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রদ্রোহ। পাকিস্তানের পরবর্তী শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধানেরা জিন্নাহর তৈরি করে দেওয়া পথ ধরেই হেঁটেছেন। এবং রাষ্ট্র ও সরকারকে ভিন্ন অস্তিত্বে দেখতে শেখেননি। গোটা পাকিস্তানি শাসনামলে রাষ্ট্রনায়কেরা রাষ্ট্রদ্রোহ শব্দটার চমকপ্রদ সদ্ব্যবহার করেছেন। জেল, নির্যাতন, জুলুম, হত্যা—কিছুই বাদ যায়নি।
রেসকোর্সের বক্তৃতায় পাকিস্তানের স্থপতি বাংলার বিরুদ্ধে এবং উদুর্র পক্ষে কথাগুলো বেশ জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে এবং ছেচল্লিশের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে বাঙালি মুসলমানের সমর্থন ছিল এককাট্টা। কথিত পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোতে রাজনীতির ভাগ্যনির্ধারক ওই নির্বাচনের ফলাফল ছিল মিশ্র ধরনের। মুসলিম লীগের একচেটিয়া প্রভুত্ব তাতে ছিল না। সীমান্ত প্রদেশে তো খান আবদুল গফফার খানের দল ও কংগ্রেস মিলে সরকার গঠন করেছিল।
সম্ভবত মুসলিম লীগের অন্যান্য অবাঙালি রাজনৈতিক নেতার মতো জিন্নাহ সাহেবের মধ্যেও বাঙালি-বিরূপতা অনুপস্থিত ছিল না। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় ছাত্রদের আন্দোলনের খবর নিশ্চয়ই তাঁকে জানানো হয়েছিল। আর সে জন্যই তাঁর জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের প্রভাবে ছাত্রদের মতামত ও আন্দোলনে পাথর চাপা দিতে তৈরি হয়েই তিনি ঢাকায় আসেন এবং পাথুরে দৃঢ়তা নিয়ে উদুর্ রাষ্ট্রভাষার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। কিন্তু বাঙালি ছাত্রসমাজকে তিনি চিনতে ভুল করেছিলেন।
প্রতিবাদ উচ্চারণের বদলে ছাত্রসমাজের একাংশ সভাস্থল ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার পথে সাজানো তোরণে কিছু ভাঙচুরও করে। অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন যে জিন্নাহ সাহেবের ভাষাবিষয়ক বক্তব্যের পর তাঁদের কিছু কর্মী ও ছাত্র ‘নো নো’ বলে চিৎকার করে ওঠে এবং সভায় হইচই শুরু হয়ে যায়
রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে উদুর্র পক্ষে তাঁর মতামত শোনার পর রেসকোর্সের জনসমুদ্রে প্রতিবাদের গুটিকয় বুদ্বুদের বেশি কিছু দেখা যায়নি। জনসভায় উপস্থিত কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যে অবশ্য মতের মিল পাওয়া যায় না। সাঈদ হায়দারের মতে, প্রতিবাদ উচ্চারণের বদলে ছাত্রসমাজের একাংশ সভাস্থল ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার পথে সাজানো তোরণে কিছু ভাঙচুরও করে। অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন যে জিন্নাহ সাহেবের ভাষাবিষয়ক বক্তব্যের পর তাঁদের কিছু কর্মী ও ছাত্র ‘নো নো’ বলে চিৎকার করে ওঠে এবং সভায় হইচই শুরু হয়ে যায় (একুশের সংকলন, বাংলা একাডেমী, ১৯৮০)।
কিন্তু ওই জনসভায় উপস্থিত কমিউনিস্ট কর্মী সরদার ফজলুল করিম সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছেন। একুশের সংকলনে প্রকাশিত স্মৃতিচারণায় (১৯৮০) তিনি বলেন: “জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার দিন আমি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলাম।...জিন্নাহ সাহেব উদুর্তে ভাষণ দেন। বক্তৃতা করতে করতে এক জায়গায় তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কমিউনিস্ট আছে, তোমাদের মধ্যে গুপ্তচর আছে, তোমাদের তারা বিভ্রান্ত করছে। আমি বলছি, ভাষার ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন উঠেছে তাতে উর্দু, কেবল উদুর্ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ জিন্নাহ সাহেবের ভাষণ শোনার পর ছাত্ররা এতই মর্মাহত হয়েছিল যে হলে ফেরার পথে (সংবর্ধনার জন্য তৈরি) তোরণ তারা ভেঙে ফেলে। অনেকে বলেছেন, জিন্নাহ সাহেব রেসকোর্সে ভাষণ দানকালে ভাষার প্রশ্নে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তার প্রতিবাদ সেখানেই হয়েছিল। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। আমি একজন সচেতন কর্মী হিসেবেই সেখানে গিয়েছিলাম...সেখানে কোনো বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ আমি লক্ষ করিনি।”
“জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার দিন আমি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলাম।...জিন্নাহ সাহেব উদুর্তে ভাষণ দেন। বক্তৃতা করতে করতে এক জায়গায় তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কমিউনিস্ট আছে, তোমাদের মধ্যে গুপ্তচর আছে, তোমাদের তারা বিভ্রান্ত করছে। আমি বলছি, ভাষার ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন উঠেছে তাতে উর্দু, কেবল উদুর্ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’
কিন্তু ২৪ মার্চ কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে জিন্নাহ সাহেব আবারও যখন উদুর্ রাষ্ট্রভাষার পক্ষে কথা বলেন, তখন উপস্থিত ছাত্রদের একাংশ থেকে প্রতিবাদ উচ্চারণ ‘নো নো নো’ সবাইকে চমকে দেয়। কার্জন হলে উপস্থিত সরদার ফজলুল করিমও একই কথা বলেছেন। কার্জন হলে জিন্নাহ সাহেব ইংরেজিতে বক্তৃতা করেছিলেন। প্রতিবাদ উচ্চারণের মুখে একটুক্ষণ চুপ থেকে যথারীতি তিনি তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন।
কার্জন হলে ‘নো নো’ উচ্চারণ পাকিস্তানের সর্বাধিনায়ককে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ছাত্রসমাজে তাঁর একাধিপত্যের অবসান ঘটতে চলেছে। ঢাকার রাজনৈতিক মহল তাদের কায়েদে আযমের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা মুখ বুজে হজম করেছিল, কোনো প্রতিবাদ করেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। জিন্নাহ সাহেবের অগণতান্ত্রিক ও বাংলাবিরোধী বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে হক সাহেব ২৩ মার্চ এক বিবৃতি দেন। দৈনিক আজাদ তির্যক শিরোনামে (হক ছাহেবের হুঙ্কার/কায়েদে আজমের প্রতি জঘন্য আক্রমণ) তা ছাপে।
সেদিন সন্ধ্যায় জিন্নাহ সাহেব সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করেন, কিন্তু তিনি তাঁর অবস্থান থেকে একটুও সরে আসেননি। প্রতিনিধিদলে ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, মহম্মদ তোয়াহা, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ। এরপর তিনি ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলেন, কিন্তু অবস্থা আগের মতোই। পূর্ববঙ্গ সফরের শেষ পর্যায়ে বেতার বক্তৃতায় তিনি পূর্বোক্ত বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করেন।
‘এখন থেকে কেউ আর মুসলমান বা হিন্দু নন, সবাই পাকিস্তানি’ ইত্যাদি। কিন্তু ঢাকা সফরে এসে একাধিক বক্তৃতায় তিনি প্রমাণ করেন যে তিনি অহংবোধে আক্রান্ত একনায়ক এবং অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক এক রাষ্ট্রনায়ক।
আজকাল কেউ কেউ জিন্নাহ সাহেবকে গণতন্ত্রী প্রমাণ করতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতার (১১ আগস্ট ১৯৪৭) কথা উল্লেখ করে থাকেন—‘এখন থেকে কেউ আর মুসলমান বা হিন্দু নন, সবাই পাকিস্তানি’ ইত্যাদি। কিন্তু ঢাকা সফরে এসে একাধিক বক্তৃতায় তিনি প্রমাণ করেন যে তিনি অহংবোধে আক্রান্ত একনায়ক এবং অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক এক রাষ্ট্রনায়ক।
জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার ফলে লীগ নেতাদের মনোবল বেড়েছিল সন্দেহ নেই। মওলানা আকরম খাঁ ৫ এপ্রিল (১৯৪৮) স্টার অব ইন্ডিয়া র প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে তিনি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কায়েদে আযমের অভিমত সম্পূর্ণ সমর্থন করেন। তাঁর মতে, উদুর্ই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।
অন্যদিকে যে ছাত্রসমাজ একসময় চোখ বন্ধ করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তাঁর মুসলিম লীগের প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছে, জান বাজি রেখে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য লড়েছে, ঢাকা সফরে তাঁর বক্তৃতা শুধু সেই ছাত্রসমাজেই নয়, জনসাধারণের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিয়েছিল (বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৫)। ভাষার প্রশ্নে এভাবেই জিন্নাহ সাহেব নিজের ভাবমূর্তি নিজেই নষ্ট করেন।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন, আহমদ রফিক, প্রথমা প্রকাশন, ২০০৯