জাল ভোট, কলঙ্কিত নির্বাচন
প্রথমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তারপর খালেদা জিয়া। এবার শেখ হাসিনা। গতকাল রোববার তৃতীয়বারের মতো একতরফা নির্বাচন দেখল বাংলাদেশ।
সব একতরফা নির্বাচনের যা চরিত্র, গতকালের নির্বাচনটিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। একতরফা নির্বাচনের কলঙ্কিত সব অনুষঙ্গই ছিল গতকালের ভোটে। ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। ফাঁকা কেন্দ্রে জাল ভোট দিয়েছেন সরকারি দলের কর্মীরা। ছিল কেন্দ্র দখল করে সিল মারার মতো গর্হিত ঘটনা।
নির্বাচন প্রতিরোধকারী বিএনপি-জামায়াতের দিক থেকে ছিল সহিংসতা, কেন্দ্র পোড়ানো, কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপার ও বাক্স ছিনতাই, ভাঙচুর, নির্বাচনী কর্মকর্তা হত্যা, মারধর এবং পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনা। গতকালই সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন। ভোটের দিনে এটাই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা।
এই একতরফা নির্বাচনেও হেরে গেছেন সরকারি দলের পরিচিত-প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা। এর মধ্যে আছে সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ আর সাংসদ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও জনগণ কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছেন।
আর বিএনপির দাবি, একদলীয় নির্বাচন জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বর্জন করেছেন, ঘৃণাভরে ভোট প্রত্যাখ্যান করেছেন।
নির্বাচন হয়ে গেলেও বিরোধী জোটের কর্মসূচি বন্ধ হয়নি। গতকাল ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের ডাকা ষষ্ঠ দফায় ২৭তম দিনের অবরোধ, সঙ্গে হরতাল। অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচির সঙ্গে আজ সোমবার সকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল যোগ করেছে তারা।
সারা দেশে প্রায় সাড়ে চার লাখ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতিতে ১১ জেলায় সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন। এর মধ্যে ১৫ জনই মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও এবারের নির্বাচন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে মারা গেছেন ১২৩ জন।
ভোটের দিন এতসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি এর আগে দেখা যায়নি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির একতরফা নির্বাচনের দিন সারা দেশে ১২ জন মারা যান, সংঘর্ষ-সহিংসতায় আহত হন প্রায় পাঁচ শতাধিক। আর অষ্টম সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন ২০০১ সালের ১ অক্টোবর তিন জেলায় পাঁচজন নিহত হন। সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট হয় ২০০৮ সালে। ২৯ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনের দিনটি কোনো রক্তপাত ছাড়াই শেষ হয়।
এবারের ভোটের আগের দিন শুরু হওয়া সহিংসতা গতকাল ভোট গ্রহণের পুরো সময়জুড়ে বজায় ছিল। আগের দিন আগুনে পুড়েছে ১১১টি ভোটকেন্দ্র। নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনতাই হয়েছে, কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে নির্বাচনী কর্মকর্তাকে। ভোটের দিনও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন নির্বাচনী কর্মকর্তা। ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতা হয়েছে ৬৯৭ কেন্দ্রে। ৩৬টি আসনের ৫৩৯টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেও প্রায় আড়াই হাজার কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করতে হয়েছিল।
আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান ১৫৩ জন। ৫৯ জেলায় বাকি ১৪৭ আসনে যে চার কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভোট দিতে যাননি। দেশের ৩৯টি কেন্দ্রে একটিও ভোট পড়েনি। শুধু লালমনিরহাট-৩ আসনের ২৭টিতে কোনো ভোট পড়েনি। ১৬টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১ থেকে ৬৩টি।
খালেদা জিয়ার একতরফা নির্বাচনে সব কারচুপির পরও ভোটার উপস্থিতি দেখানো গিয়েছিল ২৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গতকালের নির্বাচনে কত ভোটার ভোট দিয়েছে, তার হিসাব গত রাত একটা পর্যন্ত দেয়নি নির্বাচন কমিশন। তবে ঢাকা বিভাগে ৪৪.৫১ এবং ঢাকা মহানগরে ২২.১৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে বেসরকারিভাবে জানানো হয়েছে।
গতকালের একতরফা নির্বাচনে চট্টগ্রামে ভোটার উপস্থিতির হার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। আর উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় ভোটার ছিল সবচেয়ে কম। অর্ধেক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণই হয়নি। রাজশাহী, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কক্সবাজার, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, ফেনী ও ঢাকার কয়েকটি আসনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল।
এর মধ্যেও প্রাপ্ত হিসেবে দেখা গেছে, মিনিটে ১৮ ভোট পড়েছে ঢাকা-১৮ আসনের কয়েকটি কেন্দ্রে। আবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ ও তাড়াইল এবং সিরাজগঞ্জ-৫, রাজশাহী-৬, লক্ষ্মীপুর-৪ প্রভৃতি আসনের কয়েকটি জায়গায় ব্যাপক জাল ভোট দেওয়ার পরও ভোটার উপস্থিতি খুব বেশি দেখানো যায়নি। এ জন্য ভোট গ্রহণ শুরু পর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন ১৯ প্রার্থী।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার স্বার্থে এই যে নির্বাচন হলো, সেটাকে আমি ঠিক নির্বাচন বলতে চাই না। যারা এই নির্বাচন আমাদের ওপর চাপিয়ে দিল, আর যারা নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে দেশজুড়ে সহিংসতা চালাল, তাদের দুই পক্ষের মধ্যে আমরা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির একটি নির্লজ্জ, সহিংস, নৃশংস চিত্র দেখলাম। এই নির্বাচনে কেউ জেতেনি, সবাই পরাজিত হয়েছে। যদি কেউ জিতে থাকে, তা হলো একটি ক্রমবর্ধমান উগ্র ধর্মান্ধ শক্তি, যারা সারা দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, এই নির্বাচনের মাধ্যমে তারা আরও বলবান হওয়ার সুযোগ পেল।’
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, সরকারপ্রধানের ভাষাতেই বলতে হয়, ক্ষমতাসীন দল খালি মাঠে গোল দিল। এই নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি, জনগণের ম্যান্ডেট তারা অর্জনও করেনি।