জানু মিয়ার পেটে গুলির ক্ষত, বকুলের উড়ে গেছে দুটি আঙুল
লিবিয়া থেকে প্রায় পঙ্গু হয়ে ফিরলেন ৯ বাংলাদেশি
সংবাদ সম্মেলনে দুর্বিষহ জীবনের কথা বললেন তাঁরা
২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আহত হন সবাই
পরনের গেঞ্জিটা একটুখানি তুলতেই জানু মিয়ার পেটের একপাশে গুলির ক্ষত দেখা গেল। তাঁর পাশে তখন দাঁড়িয়ে মো. বকুল হোসেন। বকুলের হাতের দুটি আঙুল উড়ে গেছে। পেছনে গুলিবিদ্ধ ফিরোজ ব্যাপারী ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারেন না আর। বাংলাদেশের এই তরুণেরা ভাগ্য ফেরাতে লিবিয়া গিয়েছিলেন। একরকম পঙ্গু হয়ে দেশে ফিরেছেন।
তবু এই তরুণেরা খুশি। অন্তত প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন তাঁরা। সঙ্গের ২৬ সহযাত্রী লিবিয়ার মিজদাহতে নিহত হয়েছিলেন চলতি বছরের ২৯ মে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ৯ জনকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরিয়ে এনেছে। লিবিয়াফেরত এই বাংলাদেশিরা হলেন ফিরোজ ব্যাপারী, জানু মিয়া, ওমর শেখ, সজল মিয়া, তরিকুল ইসলাম, বকুল হোসেন, মো. আলী, সোহাগ আহমেদ ও সাইদুল ইসলাম।
লিবিয়ায় থাকা দেশীয় দালালদের ধরতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া চলছে।আবদুল্লাহীল বাকী, উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি)
আজ রোববার সিআইডি লিবিয়াফেরত ব্যক্তিদের সংস্থাটির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির করে। এরপর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় আদালতে। সেখানে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তাঁরা। সংবাদ সম্মেলনে মো. জানু মিয়া বলেন, তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। লিবিয়ায় যেতে তিনি স্থানীয় দুই দালাল সোহাগ ও শ্যামলকে ধরেছিলেন। তাঁদের অফিস আছে মতিঝিলে। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর জানু সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যান। বাসে করে কলকাতা নিউমার্কেটের কাছের একটি হোটেলে ওঠেন। সেখান থেকে পরদিন প্লেনে মুম্বাই চলে যান। ওখানকার বাঙালি দালাল তাঁকে দুবাই পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেখানেও বাঙালি দালালদের পান। ওই দালালেরা শারজায় কয়েক দিন থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন জানু মিয়ার। সেখান থেকে মিসর পৌঁছে আরও অন্তত ১০০ মানুষকে পেয়ে যান জানু। এরপর তাঁরা পৌঁছান লিবিয়ার বেনগাজিতে। বেনগাজির একটি কারখানায় যোগ দেওয়ার পর জানু মিয়া বুঝতে পারেন তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করেছে দালাল চক্র। মাসে ৪০ হাজার টাকা বেতন পাবেন—এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তিনি ১৭–১৮ হাজার টাকার বেশি পাননি।
দালালেরা ওই সময় জানু মিয়াকে বলেন, ত্রিপলিতে গেলে অনেক টাকা বেতনে চাকরি পাওয়া যাবে। এ পর্যায়ে যে দালালের পাল্লায় তিনি পড়েন, তাঁর নাম তানজুল। তাঁর বাড়িও কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। জানু মিয়া ভয় পাচ্ছিলেন প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার দূরের শহরে যেতে। তানজুল বলেন, ৬০ হাজার টাকা দিলে তিনি সব দায়িত্ব নেবেন। জানু মিয়ার বড় ভাই মুন্না নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে তানজুলের বড় ভাইকে ওই টাকা পরিশোধ করেন। বেনগাজি থেকে ৩০ জন বাংলাদেশি ৩টি গাড়িতে করে রওনা দেন। গাড়ির তিন চালক ছিলেন লিবীয়। ত্রিপলি পৌঁছানোর আগে তাঁদের ওপর হামলা চালায় অপহরণকারীরা। একজন গাড়ির সিটের নিচে লুকিয়েছিলেন। ওই ব্যক্তি বাদে ২৯ জনকে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন দিন পর তাঁদের সবাইকে আরেক দলের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাঁরা মিজদাহতে পৌঁছান ২০ মে। অপহরণকারীরা ক্যাম্পে ঢুকেই লাশ দেখতে পান। তাঁরা জানান, প্রত্যেকে ১২ হাজার ডলার দিলে ছাড়া পাবেন। নইলে তাঁদেরও মরতে হবে। প্রতিদিনই দু–তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হতো। বাংলাদেশি ছাড়াও ওখানে নাইজেরিয়া, ঘানা ও সুদানের নারীসহ শতাধিক মানুষ আটক ছিলেন।
জানু মিয়া জানান, একদিন বেদম মারপিটের মুখে নাইজেরিয়ার নাগরিকেরা পাল্টা হামলা করে একজন অপহরণকারীকে হত্যা করেন। এরপরই সবার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়, ককটেল ছোড়া হয়। গুরুতর আহত ১২ জন বাংলাদেশিকে অপহরণকারীরা দূরের একটা মরুভূমিতে ফেলে চলে আসে। দুই–আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা এক সুদানি নাগরিকের আশ্রয় পান। তিনিই সেনাসদস্যদের হাতে তুলে দেন বাংলাদেশিদের। ত্রিপোলির একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও, কেউ দেখাশোনা করছিল না বাংলাদেশিদের। পরে সে দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের হস্তক্ষেপে চিকিৎসা হয় তাঁদের।
৯ জন ফিরে এলেও এই দলের আরও ৩ জন বাপ্পী দত্ত, সম্রাট খালাসী ও সাজিদ রয়ে গেছেন লিবিয়ায়।
লিবিয়ার মিজদাহতে ২৬ বাংলাদেশি নিহতের ঘটনা ও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রতি বর্বরোচিত হামলার খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমে। এ ঘটনায় মোট ২৬টি মামলা হয়েছে দেশে। সিআইডি একাই করেছে ১৫টি মামলা। এ পর্যন্ত এই ঘটনায় ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন বিভাগের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আবদুল্লাহীল বাকী জানান, লিবিয়ায় থাকা দেশীয় দালালদের ধরতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া চলছে।