ইতিহাস
জাদুঘর হবে স্মৃতির অস্ত্রাগার
সিএমপির সাবেক অতিরিক্ত ডিসি মইনুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে এ জাদুঘরের কাজ শুরু হয়। তিনি এখন চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
সুউচ্চ পাহাড়ের ওপর গাছপালাঘেরা ছোট একটি লাল ভবন। ইট–সুরকির একতলা চারকোনা ঘরটিকে পাখির চোখ করেছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। সেটা ১৯৩০ সালের কথা। ঘরটি ছিল ইংরেজ পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সের ব্যারাক। রাখা হতো অস্ত্র। ১৮ এপ্রিল রাতে দামপাড়ার এ অস্ত্রাগার দখলের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামকে চার দিনের জন্য স্বাধীন করেছিলেন বিপ্লবীরা। ‘ঐতিহাসিক অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ নামে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয় দিনটি।
সেই অস্ত্রাগার আজও ঠিক তেমনি আছে, শুধু অস্ত্র নেই। ঘরটির স্থাপত্যশৈলীতে ব্রিটিশ আমলের ছাপ। দুদিকে কাঠের কারুকাজ করা দুটি বাতায়ন, তখনকার লোহার রডের বেষ্টনীযুক্ত। পূর্বমুখী একটি দরজা। অন্তত ২০ ইঞ্চি পুরু দেয়াল, ছয়টি ইটের পিলারের ওপর দাঁড়ানো এ ভবন। ভেতরের আয়তন বড়জোর ১৪০ বর্গফুট। প্রায় ১৪ ফুট উঁচু ঘরটির ছাদ ভেতরে বাঁকানো গম্বুজ আকৃতির।
এখানে থরে থরে সাজানো থাকত ইংরেজদের অস্ত্র। ইতিহাস সাক্ষী, সেই ঘরটিকে ঘিরে জাদুঘর তৈরির কাজে হাত দিয়েছে নগর পুলিশ (সিএমপি)। যেখানে থাকবে ব্রিটিশ বিপ্লবের কীর্তিগাথা সব স্মারক। ইতিমধ্যে অস্ত্রাগারটির দেয়ালে ঠাঁই পেয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা মাস্টারদা সূর্য সেন ও প্রথম নারী শহীদ বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ছবি।
ব্রিটিশ যুদ্ধের পথ ধরে ১৯৭১–এর মুক্তিসংগ্রামকে একীভূত করতে চায় এ জাদুঘরে। বিপ্লবীদের মতো একাত্তরে স্বাধীনতাসংগ্রামে চট্টগ্রামের পুলিশের অবদানও তুলে ধরা হবে এ জাদুঘরে, ‘ব্রিটিশ থেকে একাত্তর’ এ ভাবধারায়।
ঘরটির সংস্কারকাজ চলছে এখন। রং–আদল সবকিছু একই থাকবে। এ দালানের লাগোয়া আরেকটি বড় একতলা ভবনকেও জাদুঘরের আওতায় আনা হয়েছে। ওই ঘর ছিল পুলিশ ব্যারাক। ব্রিটিশ যুদ্ধ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্নের সম্মিলন ঘটবে দুটি ভবনের এ জাদুঘরে।
সিএমপির সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (সদর) মইনুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে এ জাদুঘরের কাজ শুরু হয়। তিনি এখন চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।
মইনুল তুলে ধরলেন জাদুঘর গড়ে তোলার পেছনের কাহিনি, ‘বিংশ শতকের গোড়ায় যদি ব্রিটিশ বিপ্লব না হতো, তাহলে আমাদের আজকের অবস্থান হতো কিনা জানি না। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পথ ধরেই ভাষাসংগ্রাম এবং মুক্তিসংগ্রাম রচিত হয়েছে। অস্ত্রাগারটির অবস্থান জানার পর সিএমপি কমিশনার মহোদয় জাদুঘর করার উদ্যোগ নেন।’
ব্রিটিশ সময়ে চট্টগ্রাম শহর ছিল ফিরিঙ্গিবাজারের দিকে। দামপাড়া এলাকা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। পুলিশ লাইনের বর্তমান পাহাড়টি তখন অনেক উঁচু ছিল। রাস্তা ছিল অনেক নিচুতে। ৯০ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের দিনটির স্মৃতিচারণামূলক লেখায় এলাকাটির পরিচয় মেলে।
‘ইংরেজ রিজার্ভ ফোর্সের সদস্যরা এ দেশের সন্তান। তাই বিপ্লবীদের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন সিদ্ধান্ত নিলেন, অস্ত্র নিয়ে লড়াই করার আগে রিজার্ভ ফোর্সের সদস্যদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতে হবে। রাতের অন্ধকারে বিপ্লবীরা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে উঠতে ধ্বনি দিতে থাকেন, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক) আর গান্ধীরাজ হো গিয়া, ভাগো (গান্ধীর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে, পালাও) স্লোগানের পাশাপাশি আকাশের দিকে ফাঁকা গুলিও চলল। আর তাতে বিভ্রান্ত হয়ে পালালেন বেশির ভাগ রিজার্ভ ফোর্স সদস্য।
‘ওপরে ওঠার পর প্রহরারত সান্ত্রি ও হাবিলদার প্রথমে সামরিক পোশাকে সজ্জিত বিপ্লবী গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিংকে দেখতে পেয়ে নিজেদের কোনো কর্মকর্তা মনে করে সালাম দেয়। রাইফেলধারী সান্ত্রি দুই বিপ্লবী নেতার গুলিতে যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, তখন আর কোনো লড়াইয়ের দরকার হয়নি। রাইফেল, গুলি ও অস্ত্রাগার ফেলে ইংরেজ সরকারের বেতনভুক্ত এই সব দরিদ্র দেশবাসী ব্যারাক ত্যাগ করে পালিয়ে যান।’ পূর্ণেন্দু দস্তিদারের স্বাধীনতাসংগ্রামে চট্টগ্রাম বইয়ে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বর্ণনা এভাবে দেওয়া রয়েছে। দামপাড়ার আগে একই দিন পাহাড়তলী রেলওয়ে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেছিলেন বিপ্লবীরা। পরে দামপাড়ার এ লাল কুঠিতে সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের প্রধান দপ্তর স্থাপন করা হয়েছিল। গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহসহ বিপ্লবীরা রাইফেল দিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন সেখানে।
‘এ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে তখনকার বাঙালি যুবকেরা যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা পড়লে আমি এখনো শিহরিত হই। এখানে সূর্য সেনকে বিপ্লবীরা সালাম জানিয়েছিল। এ স্মৃতি যদি আরও আগে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারতাম, তাহলে প্রয়াত বিপ্লবী বিনোদ বিহারীকে আমরা পেতাম। এ ছাড়া অনেক স্মৃতিচিহ্নও পাওয়া যেত। এখন আমরা প্রীতিলতার ব্যবহৃত অস্ত্রটি ঢাকা জাদুঘর থেকে সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি।’ আক্ষেপ মইনুল ইসলামের।
দামপাড়ার ছোট্ট কুঠিটিতে গিয়ে কয়েক বছর আগে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখার্জি শ্রদ্ধার্ঘ্য দেন। লাল ভবনটির সামনে সূর্য সেন ও প্রীতিলতার ছবি দিয়ে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সারসংক্ষেপসংবলিত একটি নামফলকও তোলা হয়েছিল তখন। তবে অস্ত্রাগার দখলের সময় প্রীতিলতা ছিলেন কলকাতায়। সেখানে বসে তিনি অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের খবর পত্রিকায় পড়েছিলেন। এরপর মাস্টারদার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন প্রীতিলতা। ফিরে আসার পর ১৯৩২ সালের ১৩ জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে দুজনের সাক্ষাৎ হয়। সে দিনটি ধলঘাট যুদ্ধ নামে পরিচিত।
লাল ভবনের জাদুঘরে প্রীতিলতাসহ সব বিপ্লবীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় থাকবে। প্রীতিলতার ব্যবহৃত অস্ত্রটিও সংগ্রহের জন্য চিঠি দিয়েছে সিএমপি কর্তৃপক্ষ। এটা এখন ঢাকা পুলিশ জাদুঘরে রয়েছে। ব্রিটিশ বিপ্লবের চার দশক পর এ লাল কুঠিকে সাক্ষী রেখে ১৯৭১ সালে আরেক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিলেন বীর পুলিশ সদস্যরা। স্বাধীনতা ঘোষণার দুদিন পর ২৮ মার্চ ভোরে পাকিস্তান বাহিনী দামপাড়া পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছিল। বিপ্লবী বলে বলীয়ান পুলিশ সদস্যরা সেদিন সাধারণ অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগানের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
শহীদ হন এসপি শামসুল হক, ওসি আবদুল খালেকসহ ৫১ জন পুলিশ। এ ছাড়া পুলিশ সুপারের বাসভবনসহ বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধে মোট ৮২ পুলিশ শহীদ হওয়ার তথ্য রয়েছে সিএমপির কাছে। তাঁদের স্মৃতিও তুলে ধরা হবে জাদুঘরের।
‘এটা আমাদের জন্য অনেক গৌরবের। ব্রিটিশ বিপ্লবের স্মৃতির সঙ্গে পুলিশের নাম জড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদান কম নয়। সবগুলোর সম্মিলন ঘটবে এ জাদুঘরে। এটা গতানুগতিক জাদুঘর হবে না। এতে বিভিন্ন হলোগ্রামের মাধ্যমে ইতিহাসকে তুলে ধরা হবে। যাতে শিক্ষার্থীসহ বর্তমান প্রজন্ম ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।’ বললেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর।
জাদুঘরটির অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ এখন শেষ পর্যায়ে। উপপুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) বিজয় বসাক আশাবাদী, ডিসেম্বরের মধ্যে এ জাদুঘর উদ্বোধনের ব্যাপারে। এর কাজের তত্ত্বাবধান করছেন বর্তমান অতিরিক্ত উপকমিশনার (সদর) শেখ শরীফ উজ জামান। হলোগ্রাম ভিডিওচিত্রের কাজগুলোর দায়িত্বে রয়েছেন জিল্লুর রহমান নামের এক যুবক।
তাঁরা তুলে ধরলেন জাদুঘরের মূল ভাবনা। জাদুঘরের দুটি কক্ষের নিচের ধাপে রয়েছে একটি শহীদ মিনার। ফুলের বাগানসহ ওয়াকওয়ে থাকবে দুদিকে। জাদুঘরের সামনে পাঁচ মিনিটের একটি লেজার শোর ব্যবস্থা করা থাকবে প্রতিদিন।
জাদুঘরে দর্শনার্থী শিক্ষার্থীরা প্রথমে একটি কক্ষে ঢুকবে। সেখানে একজন মুক্তিযোদ্ধা ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে তাঁর কীর্তিগাথা তুলে ধরবেন। ছোট ঘরটি পার হয়ে বড় কক্ষটি। সেখানে দেয়ালে থাকবে মুক্তিযুদ্ধে অবদানকারী পুলিশের ছবি স্মারক ইত্যাদি। ব্রিটিশ আমল থেকে পুলিশের পোশাকের নানা বিবর্তনও তুলে ধরা হবে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ডিজিটাল অ্যালবাম থাকবে বড় কক্ষটির এক প্রান্তে। এ বড় কক্ষ লাগোয়া সেই ঐতিহাসিক অস্ত্রাগারটি। যেখান থেকে বাঙালির বীরত্বের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল।
বিপ্লবীরা অস্ত্রাগার আক্রমণ করেছিলেন দেশকে স্বাধীন করতে। সে যাত্রায় তাঁরা সাময়িকভাবে সফলও হয়েছিলেন। তার ৪১ বছর পর পাকিস্তানিরা সেই পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছিল বাঙালিকে পরাধীনতার দিকে ঠেলে দিতে। তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। পদ্মাপারে স্বাধীনতার লাল সূর্য ঠিকই উদিত হয়েছিল।