জাগতিক বন্ধন: করোনা ও বাহ্যিক দূরত্ব

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

রাত সোয়া ১০টা প্রায়, আজ আকাশে মেঘের ঘনঘটা। সুনসান নীরবতা আর একটা ঘোর অমানিশার অবিসংবাদিত ছায়া। রজ্জুবদ্ধ একটা শিকড়ের মায়া, নীলচে মায়া। হালকা নীল-কালো পীত রঙের মায়া। আবছা অন্ধকার, লাল-নীল স্বপ্নের আড়ালে এক দৈত্য-দানবের বলয়। চীন থেকে স্পেন, আমেরিকা থেকে ইউরোপ, এশিয়া বলি আর আফ্রিকা, এ এক কালো চাদরে মোড়ানো স্বপ্ন।

আমি দেখি, ছোট্ট কিশোরের চোখ থেকে ঠিকরে বের হওয়া হাজারো স্বপ্ন, আমি দেখি মাইলের পর মাইল পাড়ি দেওয়া পাইলটের চোখে মৃদু অমাবস্যা, আমি দেখি বিকেলের রোদে ছাদে ওঠা বাতাসে মেঘের ভেলায় ভাসানো ঘুরি ওড়ানোর নিরামিষ উৎসব।
আমি এখন আর শুনি না, বাজখাঁই গলায় মারামারি, চিৎকার। আমি দেখি না অর্ধনগ্ন পরির চতুষ্কোণ ফ্রেমের দেয়ালের টেলিভিশনের বর্ণচ্ছটা। সেই ২টা বেজে ৩০ মিনিটে একটা নোটিফিকেশন: মোট আক্রান্ত, মোট মৃত, যোগ-বিয়োগ-গুণ—এ তো চলছেই সমান্তর।
নীরব ও নিস্তব্ধ পৃথিবীতে আমি কালের খেয়া বেয়ে তীরের খোঁজে, একটা আচমকা বিদ্যুচ্চমকের মতো ধুপ করে চোখের সামনের পর্দাটুকু সরে গিয়ে হয়তো বলবে শেষ এই দৃশ্যপটটুকু কালক্ষণে আবার হবে এই দুঃস্বপ্নের স্মৃতিচারণা।

অবাক নয়নে বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ফোকলা দাঁতে হাঁ করে তাকিয়ে থাকব যখন কয়েক শতাব্দী পর, আমার দাদুভাই যখন ‘দাদা দাদা, তুমি কী ভাবছ?’ বলে আমার ভর করা লাঠিটা ধাক্কা দিয়ে দেবে। আমি ভাবব, সেই লাশের সারি, সেই নির্লিপ্ততা, সেই নিষ্ঠুর পৃথিবী, সেই মাস্কের নির্মম ব্যবসা, সেই চিকিৎসক নামক ফেরেশতাদের আত্মত্যাগ, পুলিশ ও প্রশাসনের ঘাম ঝরানো রাত-ভোর, আর ফার্মাসিস্টের নতুন জীবনের খোঁজে ভ্যাকসিন ও রেমডেসিভির—হুহ, সবই কি দুঃস্বপ্ন!
যেন উপন্যাস পড়ছি। না না, কোনো কালজয়ী বই, ওয়ার্ল্ড বেস্টসেলার কিছু হবে হয়তো। ও বাবা, তার চিন্তাভাবনার জগৎ কত প্রসারিত, এত গভীর করে ভাবতে পারে কেউ!
‘দাদু, চলো না! আম্মু ডাকছে খেতে।’ চশমায় হা দিয়ে চাদরের কোণঘেঁষা মুছে দিয়ে হাঁটা দেব।
নাহ্‌, এ উপন্যাস আর পড়ব না, এ কেমন কথা, মানুষে দূরত্ব থাকবে, কোলাকুলি, হ্যান্ডশেক, সৌহার্দ্য-বন্ধন, সম্প্রীতি—সব চলে যাবে। এটা কিছু হলো!
নাহ্‌, অবাস্তব আর কল্পনাবিলাসী কোনো লেখকের লেখা আমার ভালো লাগে না। এ বই আর পড়া যাবে না। লেখক ক্রিস্টোফার বেনিঙ্কটন কি ছাইপাঁশ লেখেন। ‘বাবা, আপনার খাওয়ার আগের ইনসুলিনটা নিয়েছেন? বাবা আ–আ–আ–আ।’
ধুপ করে ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ কচলে দেখি কই চশমা, কই নাতি আর কই নতুন সাল।
আমি তো ঠায় দাঁড়িয়ে সেই অন্ধকার ঘেরা অমানিশার করোনাকালে।
তবে মোর ঘুমই ভালো ছিল!

*ফার্মাসিস্ট, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। [email protected]