নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানের নির্দেশে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য হন। ভিডিও ফুটেজ দেখে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে উপস্থিত স্থানীয় জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদ ওই নির্দেশ দেন বলে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে।
শ্যামল কান্তিকে লাঞ্ছনার ঘটনায় বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদনে এটিসহ ছয়টি সিদ্ধান্ত এসেছে। আজ রোববার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
মোট ৬৫ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে আরও নথিপত্র রয়েছে। তদন্তকালে মোট ২৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
প্রথম সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, শ্যামল কান্তি ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ রিফাত হাসানকে গত বছরের ৮ মে মারধর করেছেন বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, ইসলাম ধর্ম ও আল্লাহকে নিয়ে শ্যামল কান্তির কটূক্তি করার সত্যতা পাওয়া যায়নি।
তৃতীয় সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৩ মে ওই স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সভা চলাকালে স্থানীয় জনৈক শামসুল হকের ছেলে অপুর নেতৃত্বে ১০-১২ জন সভাকক্ষে ঢুকে প্রধান শিক্ষককে মারধর করার বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে অপু ছাড়া বাকি ১০-১২ জনের নাম কোনো সাক্ষীই প্রকাশ করেননি।
তদন্ত প্রতিবেদনের চতুর্থ সিদ্ধান্ত, গত বছরের ১৩ মে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভা চলাকালে আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় মসজিদ থেকে ঘোষণা প্রদান করা হয় যে ইসলাম ধর্ম ও আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন শ্যামল কান্তি। কে বা কারা ওই ঘোষণা দিয়েছেন, তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিরোধের কারণে এমন ঘোষণা দেওয়া হতে পারে বলে বিশ্বাস করার কারণ আছে।
পঞ্চম সিদ্ধান্তে আছে, গত বছরের ১৩ মে বিকেল পাঁচটার দিকে সাংসদ সেলিম ওসমান প্রধান শিক্ষকের রুমে ঢুকে তাঁকে গাল-কান জুড়ে দুই হাত দিয়ে পরপর চারটি থাপ্পড় দিয়েছেন—এমন দাবির সত্যতা পাওয়া যায়নি।
শেষ সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, সাংসদ সেলিম ওসমানের নির্দেশে শ্যামল কান্তি ভক্ত কান ধরে ওঠবস করতে বাধ্য হয়েছেন—ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে উপস্থিত স্থানীয় জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদ ওই নির্দেশ দেন।
১৯ জানুয়ারি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম শেখ হাফিজুর রহমান ওই প্রতিবেদন হলফনামা আকারে দাখিল করেন।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে গত বছরের ১৩ মে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লাঞ্ছিত করার ঘটনাটি প্রকাশ পেলে দেশজুড়ে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানই যে সেদিন শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে ওঠবস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতেও তা দেখা যায়। ওই ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আনা হলে গত ১৮ মে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুলসহ আদেশ দেন। নির্দেশ অনুসারে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই ঘটনায় পুলিশ প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে মন্তব্য করে গত বছরের ১০ আগস্ট হাইকোর্ট পুরো ঘটনা তদন্ত করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমকে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন। ওই ঘটনার পরপরই শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে চাকরিচ্যুত করেছিল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে নিন্দা-প্রতিবাদের মধ্যে দুই দিনের মাথায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। নিয়মবহির্ভূত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিদ্যালয় কমিটিও বাতিল করা হয়। দীর্ঘদিন ঢাকায় চিকিৎসা নেওয়ার পর ওই বছরের জুলাই মাসে স্কুলে ফিরে যান শ্যামল কান্তি।
আরও পড়ুন: