চোখ-কানের সমস্যায় আশপাশের বাসিন্দারা, কাটছে না ভয়

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কদমরসুল এলাকায় রাস্তার পাশে আশরাফুর রহমানের দোকান। চা-বিস্কুট, কোমল পানীয় ইত্যাদি বেচেন তিনি। এই দোকান থেকে বিএম কনটেইনার ডিপোর দূরত্ব ৫০০ গজের মতো। শনিবার রাতে ডিপোয় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হলে আশরাফুরের দোকানে থাকা রেফ্রিজারেটরের কাচ ভেঙে পড়ে যায়। ওই সময় দোকানেই ছিলেন আশরাফুর। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর চোখে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। এখন চোখ-মুখ ফুলে গেছে।

আশরাফুর রহমান গতকাল বুধবার বলেন, বিস্ফোরণের কিছুক্ষণের মধ্যে দোকানঘর অন্ধকার হয়ে যায়। চোখ জ্বালাপোড়া করছিল। পরে মুখ ফুলে যায়। এ ছাড়া কাশি যাচ্ছে না। শরীরও চুলকাচ্ছে।

আরও পড়ুন

আশরাফুরের বাড়ি দোকানের কাছেই, সোনাইছড়ির সদুপাড়া এলাকায়। বিস্ফোরণের সময় তাঁদের বাড়ির ঘরে ছিলেন দুই বোন। এর মধ্যে বড় বোন নাসরিন আকতার (২৭) ডান কানে কম শুনছেন। এ জন্য গত মঙ্গলবার চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। ছোট বোন শাহনাজ পারভীন (২০) ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে বারবার উঠে বসছেন।

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আশপাশের প্রায় দুই কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে গতকাল কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা প্রত্যেকেই শারীরিক নানা সমস্যার কথা জানান। এর মধ্যে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে বেশির ভাগেরই কানে সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে ছোটরা একধরনের ভয়ের মধ্যে আছে। বিস্ফোরণের সময় ছুটে যাওয়া ধাতব টুকরার আঘাতে আহত হয়েছেন কেউ কেউ। ঘটনার পর চোখ জ্বালাপোড়া এবং পরে মুখ ফুলে যাওয়ার কথা বলেছেন প্রায় সবাই।

হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের বিস্ফোরণের কারণে এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ মো. মিনহাজুল হক। তিনি বলেন, বিকট শব্দ ও বিস্ফোরণের বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত চাপের কারণে অনেক সময় কানের পর্দা ফেটে যায়। চোখ-মুখ ফুলে যায় রাসায়নিকের কারণে। এ ছাড়া চোখেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। যাঁদের গায়ে সরাসরি রাসায়নিক পড়েছে, তাঁদের ক্ষতি বেশি হবে।

সরেজমিনে বিএম কনটেইনার ডিপোর পাশে অলিনগর মোল্লা পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, রিদুয়ানুর রহমান নামে এক যুবকের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। রিদুয়ানুর এবার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর তিনি বাড়ির পাশে রাস্তায় ছিলেন। বিস্ফোরণে তাঁর মাথায় কিছু একটা ছিটকে এসে লাগে।

রিদুয়ানুর বলেন, ‘মাথায় কী একটা এসে পড়েছিল। মাথায় হাত দিয়ে দেখি রক্ত পড়ছে। পরে আমি ঘরে চলে আসি। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মাথায় ১০টি সেলাই পড়ে।’

ডিপো থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বের কাশেম জুট মিল এলাকার রশিদা বেগম জানান, তাঁদের বাড়িতে একটা টুকরা এসে পড়েছিল। ছাউনির ওপর পড়ায় টিন বাঁকা হয়ে গেছে। বিস্ফোরণের পর থেকে তাঁর কান ব্যথা করছে বলে তিনি জানান। চোখ-মুখও জ্বালাপোড়া করছে।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আশপাশের বাসিন্দাদের কতজন শারীরিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চোখের সমস্যা নিয়ে ৬৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ চোখে ঝাপসা দেখছেন। তাঁদের দীর্ঘদিন চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

সরেজমিনে গতকাল বিএম কনটেইনার ডিপোর পাশে কদমরসুল, সোনাইছড়ি ও আলীনগর এলাকার কয়েকটি বাড়ির ও একটি মসজিদের জানালার কাচ ভাঙা অবস্থায় দেখা যায়। বাসিন্দারা জানান, বিস্ফোরণের সময় কাচ ভেঙে যায়। কয়েকটি পাকা বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া দোকান ও ঘরের টিনের ছাউনি বেঁকে গেছে। সব মিলিয়ে ২০টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ডিপো থেকে আধা কিলোমিটার দূরে আলীনগর এলাকায় নার্গিস আকতারের বাড়ি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণের পর বাড়ির উঠানে এসে আগুনের শিখার মতো জ্বলন্ত একটি বস্তু এসে পড়ে। তা নেভাতে গিয়ে একজনের পা পুড়ে যায়। নার্গিস আকতার বলেন, বিস্ফোরণের পর থেকে প্রচণ্ড গরম লাগছিল। চোখ-মুখ জ্বালাপোড়া করছিল। এ অবস্থায় গত রোববার শাশুড়িকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখনো শরীরে অস্বস্তি যায়নি বলে জানান নার্গিস আকতার।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মফিদুল আলম বলেন, ঘটনার পর এলাকার পানি ও বাতাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য দেওয়া হয়েছে। গ্যাসের কারণে মানুষের নানা সমস্যা হচ্ছে। পানির পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে। এতে দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, সিওডি (রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা) ও বিওডি (জৈব অক্সিজেন চাহিদা) গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা অনুযায়ী পাওয়া যায়নি। বাতাসের রিপোর্ট এখনো আসেনি।