২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে জনপ্রশাসনে ক্ষোভ

রেকর্ডসংখ্যক নিয়োগের পরও সরকারি চাকরিতে শূন্য পদ বাড়ছে। জনপ্রশাসনে পদ ছাড়াই ঢালাও পদোন্নতি হচ্ছে। এতে পদোন্নতি পেয়েও অধিকাংশ কর্মকর্তা আগের পদেই চাকরি করছেন। এই পরিস্থিতির মধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, পদোন্নতি নিয়ে প্রশাসনে একধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে

পদ ছাড়া ঢালাও পদোন্নতির কারণে জনপ্রশাসনে নিয়মিত কর্মকর্তারা পদ পাচ্ছেন না। অথচ উল্টো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে এই সমস্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। এ নিয়ে নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও দূতাবাস মিলিয়ে ১৪২ জন কর্মকর্তা চুক্তিতে চাকরি করছেন। তাঁদের মধ্যে ১২ জন সচিব রয়েছেন, যাঁরা অবসরে যাওয়ার পরও চুক্তিতে আছেন। নিয়মিত কর্মকর্তা থাকার পরও চুক্তিতে ১২ জন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ায় বছরে তাঁদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, মেয়াদ শেষে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করছেন আরও কিছু কর্মকর্তা। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালা নেই। সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়া ও স্বজন প্রীতি এই নিয়োগের অলিখিত প্রধান যোগ্যতা। এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে চুক্তিতে নিয়োগের বিষয়ে নীতিমালা করতে বললেও তা আর হয়নি।
নিয়মিত যোগ্য কর্মকর্তা থাকার পরও চুক্তিতে নিয়োগ দিলে সরকারের আর্থিক খরচ হয়। গাড়ির খরচ, বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা ছাড়াই একেকজন সচিবের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা। আর একেকজন জ্যেষ্ঠ সচিবের মূল বেতন ৮২ হাজার টাকা। মুখ্য সচিবের মূল বেতন ৮৬ হাজার টাকা। বর্তমানে সচিব আছেন ৭৯ জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অতিরিক্ত সচিব প্রথম আলোকে বলেন, সব কর্মকর্তা সচিব হতে পারেন না। কিন্তু সবার আশা থাকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে যাওয়ার। কিন্তু বর্তমানে সচিব পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাড়তে থাকায় এই আশায় চিড় ধরছে। এ নিয়ে প্রকাশ্যে তাঁরা কিছু বলতেও পারেন না।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষতায় ঘাটতি থাকলে কৌশলগত কিছু পদে দক্ষ কর্মকর্তাদের চুক্তিতে নিয়োগ হতে পারে, তা-ও বড়জোর একবার। কিন্তু এভাবে হতে থাকলে অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়, যা কর্মস্পৃহা নষ্ট করে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন পদে চুক্তিতে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৩১ জন প্রথম শ্রেণির। তাঁরা গ্রেড-১ থেকে গ্রেড-৫-এর কর্মকর্তা। বাকি ১১ জন দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যায়ের কর্মকর্তা। আইন মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগই চলছে চুক্তিভিত্তিক সচিব দিয়ে। এর মধ্যে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক ইতিমধ্যে তিন দফায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। সব মিলিয়ে পাঁচ বছর চুক্তিতে থাকছেন তিনি। প্রথমে এক বছর চুক্তিতে নিয়োগ পান, এরপর দুই বছর। ওই দুই বছরের মধ্যে চুক্তিতে থাকা অবস্থায় জ্যেষ্ঠ সচিবও হন। সর্বশেষ ১৪ নভেম্বর থেকে আগামী দুই বছরের জন্য তাঁকে একই পদে চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হককে গত ৬ আগস্ট অবসরোত্তর ছুটি বাতিল করে একই পদে দুই বছরের জন্য চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ দেয় সরকার, যা পরের দিন থেকে কার্যকর হয়। তাঁর এই নিয়োগ আদালত পর্যন্ত গড়ায়, যা এখন বিচারাধীন। ৭ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরীকে ১০ নভেম্বর থেকে ছয় মাসের জন্য একই পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুজন সচিবের মধ্যে দুজনই চুক্তিতে আছেন। মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে অবসরোত্তর ছুটিতে যাওয়ার পর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে এক বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। আগামী মাসে তাঁর চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। তাঁকে আরেক দফায় চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ার আলোচনা চলছে। এই পদের জন্য একাধিক সচিব চেষ্টা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগমও আছেন চুক্তিতে। তথ্যসচিব মরতুজা আহমেদ গত জানুয়ারি থেকে চুক্তিতে আছেন। গৃহায়ণ ও গণপূর্তসচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার গত মে থেকে দুই বছরের জন্য চুক্তিতে আছেন।

এ ছাড়া সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মাহবুব আহমেদ, ইতালির রাষ্ট্রদূত আবদুস সোবহান সিকদার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী আছেন চুক্তিতে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, চুক্তিতে অতিরিক্ত সচিব আছেন ছয়জন। এর মধ্যে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে চুক্তিতে থাকা অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব খন্দকার আখতারুজ্জামান ইতিমধ্যে দুই দফায় মোট দুই বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে চুক্তিতে নিয়োগ কম হয়।
চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, অপরিহার্য কারণে কিছু পদে চুক্তিতে নিয়োগ দিতে হয়। তবে সাধারণভাবে তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করেন।
পদ ছাড়াই আরেক দফা পদোন্নতি
পর্যাপ্ত পদ না থাকলেও অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে আরেক দফায় কয়েক শ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে এ সপ্তাহেই পদোন্নতি হতে পারে। জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোজাম্মেল হক খানও এ মাসেই পদোন্নতি হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, উপসচিব পদে এবার ২৪তম বিসিএস ব্যাচ থেকেও পদোন্নতি দেওয়া হবে। কিন্তু পদোন্নতি হলেও পদের অভাবে অধিকাংশ কর্মকর্তার পদোন্নতি পাওয়া পদে কাজ করার সুযোগ মিলবে না।
২০ নভেম্বর পর্যন্ত জনপ্রশাসনে মোট কর্মকর্তা ছিলেন ৫ হাজার ৭৭১ জন। এর মধ্যে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে কর্মকর্তার সংখ্যা পদের চেয়ে অনেক বেশি। যেমন উপসচিবের ৮৫০টি পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ১ হাজার ৫৫৪ জন। যুগ্ম সচিবের ৪৫০টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৭৮৭ জন। অতিরিক্ত সচিবের শতাধিক পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৪৩৫ জন।
সচিবালয়ে কর্মরত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে ঢালাওভাবে পদোন্নতি হচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় পদ বাড়ছে না। ফলে পদোন্নতি পেয়েও অনেক কর্মকর্তা এক স্তর বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই স্তর নিচের পদে চাকরি করে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে চুক্তিতে নিয়োগ দিতে থাকলে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের ওপরের স্তরের পদে যাওয়ার সুযোগ আরও কমে যায়।